শনিবার ১ নভেম্বর ২০২৫ - ১৩:২৩
ধর্মীয় নেতাদের আচরণ সমাজের নৈতিক মান নির্ধারণ করে

বাংলাদেশের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের সংকট আজ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে, শিক্ষা থেকে চরিত্রগঠনের শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে, আর ধর্মীয় নেতৃত্বও নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন বলেন, “ধর্মীয় নেতাদের আচরণ সমাজের নৈতিক মান নির্ধারণ করে। কারণ মানুষ কথার চেয়ে আচরণে বেশি প্রভাবিত হয়।”

হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেয়া ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইনের সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি বাংলাদেশের বর্তমান নৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মপ্রাণ ও নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি সমাজ ছিল। কিন্তু আজ আমরা এক গভীর নৈতিক সংকটের মুখোমুখি। সমাজে মিথ্যা, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, অবিচার ও পারিবারিক ভাঙন ক্রমেই বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত কন্টেন্ট ও বস্তুবাদী চিন্তার বিস্তার তরুণদের নৈতিকভাবে দুর্বল করে তুলছে। ধর্মীয় জ্ঞানের প্রতি অবহেলা এবং নৈতিক আত্মচর্চার অভাব আমাদের সমাজকে ধীরে ধীরে আত্মিকভাবে শূন্য করে ফেলছে।

হাওজা নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে এই নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ কী?

ড. ফারুক হুসাইন: এটি কোনো একক কারণের ফল নয়, বরং একটি সম্মিলিত সামাজিক সংকট। পরিবারে নৈতিক শিক্ষার চর্চা কমে গেছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় আত্মগঠনমূলক পাঠ অনুপস্থিত, আর রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় নৈতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। একইসঙ্গে বস্তুবাদী প্রতিযোগিতা, লোভ, ও ভোগবিলাস সমাজে এমন এক মানসিকতা তৈরি করেছে যেখানে নৈতিকতা যেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।

হাওজা নিউজ: সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী অনেক ব্যক্তিও নানা বিতর্ক ও অনৈতিক আচরণে জড়িয়ে পড়ছেন। আপনি এই প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?

ড. ফারুক হুসাইন: এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয়। ধর্মীয় নেতা বা আলেম সমাজের আচরণ সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের প্রতিচ্ছবি। যদি তারা নৈতিক বিচ্যুতিতে লিপ্ত হন, তবে মানুষ ধর্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে। এতে তরুণ প্রজন্মের মনে এক ধরনের অবিশ্বাস জন্মায় এবং তারা ধর্মীয় আদর্শ থেকে দূরে সরে যায়।
ধর্ম কেবল বক্তৃতায় নয়, বরং ব্যক্তিত্ব ও আচরণের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। তাই আমি মনে করি, ধর্মীয় নেতাদের আচরণই সমাজের নৈতিক মান নির্ধারণ করে। তাদের জীবন হতে হবে সত্য, ন্যায়, ধৈর্য ও সততার জীবন্ত উদাহরণ।

হাওজা নিউজ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিক পুনর্জাগরণের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কী হতে পারে?

ড. ফারুক হুসাইন: ইসলাম নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণের শিক্ষা দেয়। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন,
إِنَّما بُعِثتُ لِأُتَمِّمَ مَكارِمَ الأَخلاقِ.
“আমি নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” তাই প্রথম পদক্ষেপ হবে ধর্মীয় শিক্ষার পুনর্জাগরণ— ঘরে, মসজিদে, ও শিক্ষাব্যবস্থায়। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমকে হতে হবে নৈতিকতার বাহক, অশ্লীলতার প্রচারক নয়। তৃতীয়ত, ধর্মীয় (আলেম-ওলামা) ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের চরিত্র হতে হবে সমাজের জন্য অনুকরণীয়। যখন সমাজের শীর্ষে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন নিচের স্তরেও তা প্রবাহিত হয়।

হাওজা নিউজ: তরুণ প্রজন্মকে নৈতিকতার পথে ফিরিয়ে আনতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

ড. ফারুক হুসাইন: তরুণদের শুধু আদেশ-নিষেধ করলে হবে না; তাদের সামনে আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। ইসলামি ইতিহাস, আহলে বাইত (আ.) ও নববী চরিত্র থেকে আমরা অসংখ্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত পাই। প্রযুক্তি ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে তরুণদের হৃদয়ে সেই আদর্শ জাগ্রত করা জরুরি। যদি ইসলামী সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে তরুণ প্রজন্মকে পুনরায় নৈতিক ও আত্মিকভাবে জাগ্রত করা সম্ভব।

হাওজা নিউজ: শেষ প্রশ্ন— আপনি বাংলাদেশের মানুষ ও সমাজের প্রতি কী বার্তা দিতে চান?

ড. ফারুক হুসাইন: আমরা যেন আল্লাহভীতি, ন্যায়বিচার, ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর ভিত্তি করে সমাজ গড়ে তুলি। নৈতিকতা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি জাতির আত্মা। পরিবার, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নেতৃত্বের প্রতিটি স্তরে যদি আমরা নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ আবারও একটি সৎ, সচেতন ও ঈমাননিষ্ঠ সমাজে পরিণত হবে।

হাওজা নিউজ: আপনার গুরত্বপূর্ণ সময় ও পরামর্শের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনার এই বিশ্লেষণ আমাদের সমাজে নৈতিক জাগরণের আহ্বান হিসেবে প্রতিধ্বনিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha