হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইরানের তানজানিয়ার সাংস্কৃতিক কাউন্সেলর মোহসেন মা’আরেফি হযরত ফাতিমা (সা.আ.)–এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা প্রদান করেন। তিনি লিখেছেন, আফ্রিকায় শিয়াদের উপস্থিতি তাঁর কাছে সবসময়ই অনুসন্ধিৎসার বিষয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের কারণে তিনি মনে করেন, আফ্রিকার বহু অঞ্চলে ইসলাম প্রথমে তাশায়্যু বা শিয়া পরিচয়ের মাধ্যমেই প্রবেশ করেছে। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় পশ্চিম আফ্রিকায় হযরত ফাতিমা (সা.আ.)–কে ঘিরে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
তাঁর চাকরিসংক্রান্ত দায়িত্বের কারণে কয়েক বছর ধরে তিনি পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছেন। তিজানিয়া, কাদিরিয়া, আহমাদিয়া তরিকার অনুসারী এবং ফলানি, ফান্টি ও দাগোম্বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ আলাপ–পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে আহলে বাইত (আ.)–এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, বিশেষ করে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর প্রতি আন্তরিক ভক্তি তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে।
তিনি একটি স্মৃতি উল্লেখ করেন—টোগোতে এক উপজাতীয় প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে তাঁর সহকর্মী সৈয়দ কাসেমও উপস্থিত ছিলেন। মা’আরেফি যখন পরিচয় করিয়ে বলেন যে কাসেম “সৈয়দ” বা তাদের ভাষায় “শরিফ”—তখন বৈঠকের পরিবেশ বদলে যায়। উপস্থিত সবাই তার দিকে ছুটে যান, তার পোশাক স্পর্শ করে তাবারুক নেন, তাকে বরণ করতে থাকেন; যেন মুহূর্তেই তারা ভুলে যান যে তিনি একজন সরকারি কর্মী মাত্র।
পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম পরিবারগুলোতে কন্যাশিশুর জন্য “ফাতিমা” নামের বিভিন্ন রূপের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। একইসঙ্গে, বহু সুফি তরিকায় দীর্ঘ তসবিহ–জিকির, বিশেষত হাদিসে কিসা স্মরণে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)–এর নামে তাওয়াস্সুল করা হয়।
তিজানিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ আহমদ তিজানি তাঁর গ্রন্থ الأحزاب و الأوراد–এ লিখেছেন: “ফাতিমা (সা.আ.)–এর মর্যাদা বেশি নাকি আয়েশার—এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু আমি রাসূল (সা.)–এর অস্তিত্বের অংশ ফাতিমা (সা.আ.)–এর ওপর কাউকে অগ্রাধিকার দিই না। আ’রিফদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, তিনি পিতার পর ‘কুতুবুল আকতাব’-এর সর্বোচ্চ স্তর (কুতুবিয়্যাতে উজমা)–তে পৌঁছেছেন। তাঁর সঙ্গে অন্য নারীর তুলনা চলে না… নিশ্চয়ই ফাতিমা (সা.আ.) আয়েশা, মরিয়ম ও আসিয়ার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তাঁর এমন এক স্তরের কামালত ছিল, যেখানে অন্য নারীদের পৌঁছার আকাঙ্ক্ষা করাও উচিত নয়। তাঁর সৃষ্টির রহস্যও ছিল বিশেষ—তাঁর নূরানী সত্তা গঠিত হয়েছিল স্বর্গীয় উপাদান থেকে; তাই রাসূল (সা.) তাঁকে বলেছেন ‘মানবরূপী হুর’ (حوراء إنسیة)।”
(গ্রন্থ: الأحزاب و الأوراد পৃষ্ঠা ২৪২–২৪৬)
পশ্চিম আফ্রিকার বহু উপজাতিতে এখনো বিশ্বাস আছে—একজন অসৈয়দ পুরুষ কোনো সৈয়দা নারীকে বিয়ে করলে পরিবারে অস্বস্তি তৈরি হয়। সুফি আলেম সাইয়্যদ আলী হারাজমি তাঁর سيدي علي الحرازمي المغرب গ্রন্থে লিখেছেন—একবার সাইয়্যেদ আহমদ তিজানি তাঁর এক অসৈয়দ মুরিদকে এক সৈয়দা নারীকে বিয়ে না করার পরামর্শ দেন। কারণ হিসেবে তিজানি বলেন, “তুমি যদি কখনো তাকে কষ্ট দাও, তবে ফাতিমা (সা.আ.)–এর হৃদয় ব্যথিত হবে; আর যার কারণে ফাতিমা (সা.আ.) কষ্ট পান, তিনিই বাস্তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)–কে কষ্ট দেন।”
(গ্রন্থ: سيدي علي الحرازمي المغربي)
সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী অভিজ্ঞতাটি এসেছে বেনিনের আলেম শাইখ আহমদ–এর কাছ থেকে। তিনি ফলানি উপজাতির সদস্য; পশ্চিম আফ্রিকায় একটি পরিচিত যাযাবর মুসলিম জনগোষ্ঠী, যাদের সম্পর্কে ফরাসি ঐতিহাসিক মোরিস দ্য লা ফোশ বলেছিলেন, পশ্চিম আফ্রিকার সভ্যতা অনেকাংশে তাদের অভিবাসনের ফল।
শাইখ আহমদ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শিশু বয়সে গ্রীষ্মের তীব্র গরমে তাঁরা হাতে কাপড় নিয়ে রাস্তায় বের হতেন এবং ফলানি ভাষায় একটি কবিতা গাইতেন,
فاطمتو بنو بنت النبی
ویلو ننه دیم وله
পরে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, এটি ছিল ফলানি জনগোষ্ঠীর বহু পুরনো এক প্রথা। যখন দীর্ঘ খরায় বৃষ্টি না হতো, তখন গ্রামের নারীরা ধোয়ার কাপড় হাতে নিয়ে মরুপ্রান্তে বের হতেন। তাঁরা কাপড়গুলো আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে বলতেন—“হে আল্লাহ, এগুলো হযরত ফাতিমা (সা.আ.)–এর দাসীদের কাপড়। আমরা এগুলো ধুতে চাই, কিন্তু আমাদের কাছে পানি নেই।”
এভাবে তাঁরা ভাঙা–মন নিয়ে হযরত ফাতিমা (সা.আ.)–এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য তাওয়াস্সুল করতেন।
লেখক উল্লেখ করেন যে, ফলানি জনগোষ্ঠীর মূল শেকড় সুদান ও ইথিওপিয়ার নুবা অঞ্চলে। ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়, ইমাম জাওয়াদ (আ.), ইমাম হাদি (আ.), ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এবং একটি বর্ণনায় ইমাম মাহদী (আ.)–এর মাতৃবংশও নবী কন্যাদের মাধ্যমে এসেছে।
আপনার কমেন্ট