রবিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৫:৪৭
নিষ্পাপ রক্ত ও ইসলামী ন্যায়বিচার: উবাইদুল্লাহ ইবনে উমরের ঘটনা ও আহলে বাইতের আদর্শ

ইসলামে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার মানদণ্ড কী? ক্ষমতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিষ্পাপ মানুষের রক্ত মাফ করে দেওয়া কি ইসলামের শিক্ষা, নাকি প্রতিশোধের মধ্যেও ন্যায় ও সীমা করাই ইসলামের মূলনীতি? দ্বিতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডের পর ঘটে যাওয়া কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনে দেয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব নিহত হওয়ার পর তার পুত্র উবাইদুল্লাহ ইবনে উমর প্রতিশোধের নামে একাধিক নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে। আহলে সুন্নতের প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ আনসাবুল আশরাফ-এ (খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৩০) উল্লেখ রয়েছে—উবাইদুল্লাহ প্রথমে জুফাইনা নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করে, এরপর সে হত্যা করে আবু লুলুর অত্যন্ত ছোট কন্যাকে, যে ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এক শিশু।

প্রশ্ন উঠতেই পারে—আবু লুলু যদি ঘাতক হয়েও থাকে এবং শাস্তিযোগ্যও হয়, তবে সেই নিষ্পাপ শিশুকন্যার অপরাধ কী ছিল? ইসলামের কোন বিধানে একজন নির্দোষ শিশুকে প্রতিশোধের শিকার বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে?

অথচ এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন তৃতীয় খলিফা উবাইদুল্লাহ ইবনে উমরকে কোনো শাস্তি দেননি। বরং তার বক্তব্য ছিল:
“গতকাল তার বাবা নিহত হয়েছে, আজ সে নিজেই নিহত হয়েছে।”
এই বক্তব্য ইসলামের কোন ন্যায়বিচার ও শরিয়তের কোন মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—সে প্রশ্ন আজও অনুত্তরিত।

এ ঘটনায় আমিরুল মুমিনিন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) স্পষ্ট অবস্থান নেন। আনসাবুল আশরাফেই বর্ণিত আছে, তিনি উবাইদুল্লাহকে উদ্দেশ করে বলেন:
“হে ফাসিক! যদি কোনো দিন তুমি আমার নাগালে আসো, তবে তুমি যে রক্ত ঝরিয়েছ, তার বদল হিসেবে আমি তোমাকে হত্যা করব।”

এখানেই শেষ নয়। ঐতিহাসিকভাবে আরও গুরুতর একটি তথ্য উঠে আসে—নবী (সা.)-এর স্ত্রী হাফসা ছিলেন তাদের একজন, যারা উবাইদুল্লাহকে নির্দোষ মানুষদের হত্যা করতে উসকানি দিয়েছিলেন। আহলে সুন্নতের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ আনসাবুল আশরাফ (খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৪৩৩)-এ বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর নিজেই বলেন:
“আল্লাহ হাফসাকে ক্ষমা করুন।”
কারণ তিনি জুফাইনা, হরমুজগান এবং আবু লুলুর নিষ্পাপ কন্যাকে হত্যার প্ররোচনাদাতাদের একজন ছিলেন।

এখন এই আচরণের সঙ্গে আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের আদর্শ তুলনা করে দেখুন।
আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) নিজে যখন ইবনে মুলজিমের আঘাতে আহত হলেন, তখনও তিনি কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন—
“আমি যদি শহীদও হই, তবুও তোমরা কারও প্রতি জুলুম করতে পারবে না।”

কুরবুল আসনাদ (পৃষ্ঠা ১৪৩)-এ বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর পুত্র হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে বলেন:
“এই বন্দী—ইবনে মুলজিমকে—খাবার দেবে, পানি দেবে, তার খোঁজখবর নেবে। সে একজন বন্দী, সেই হিসেবেই তার সঙ্গে আচরণ করবে।”

এটাই ইসলামী ন্যায়বিচারের প্রকৃত রূপ।
অন্যদিকে, কিছু বর্ণনায় এসেছে—উবাইদুল্লাহ ইবনে উমর সেখানে উপস্থিত প্রত্যেক ইরানিকেই হত্যা করতে চেয়েছিল।

উপসংহার

এখানেই দুই চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি হলো আমিরুল মুমিনিন (আ.)-এর চিন্তাধারা—
“একটি আঘাতের বদলে একটি আঘাত, এর বেশি নয়।”

আর অন্যটি হলো সাকিফার রাজনীতিক চিন্তাধারা—
“এই ব্যক্তি নিহত হয়েছে, তার মেয়েকেও হত্যা করো; যাকে ইরানি দেখবে তাকেই হত্যা করো।”

প্রশ্ন থেকে যায়—ইসলাম আসলে কোনটি?
নিষ্পাপ শিশুর রক্ত মাফ করে দেওয়া ক্ষমতার ইসলাম, নাকি ন্যায় ও মানবিকতার ইসলাম?

রিপোর্ট: হাসান রেজা

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha