সোমবার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১১:৫০
পশ্চিমা সভ্যতার সাজানো মুখোশসমূহ

ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতার স্পষ্ট দাবির ভিত্তিতে, পশ্চিম ও আমেরিকার আধিপত্য ভাঙতে হলে আমাদের আজকের শ্রোতা–দর্শকের সামনে পশ্চিমা সভ্যতার সাজানো-গোছানো মুখোশগুলো সরিয়ে দিতে হবে এবং এই সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল স্তম্ভগুলোর ওপর বাস্তব অর্থেই আঘাত হানতে হবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাদ্দাহ ও কবিদের সঙ্গে সাক্ষাতে ইসলামি বিপ্লবের প্রজ্ঞাবান নেতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেন। যদিও বিগত বছরগুলোতে তিনি নানা উপলক্ষে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তবে এবার তাঁর বক্তব্যের স্পষ্টতা ছিল ভিন্ন মাত্রার।

তিনি এ সাক্ষাতে পরিষ্কারভাবে বলেন:
“শত্রুর মোকাবিলায় কেবল সে যে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তার জবাব দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকো না… শত্রুর বহু দুর্বলতা আছে; সেই দুর্বলতাগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করো।”
এছাড়াও তিনি অন্য এক বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন যে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রচার কেবল প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান ও জবাবদিহির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং প্রতিপক্ষের চিন্তাগত ভিত্তির ওপর আঘাত হানতে হবে।

জ্ঞানগত যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিপ্লবী উদ্যোগের অপরিহার্যতা

সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্য ও দাবিগুলো, একই সঙ্গে দেশের গণমাধ্যম বিন্যাস পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর তাঁর জোর, এমন এক লড়াইয়ের গুরুত্বকে তুলে ধরে যা বহুমাত্রিক। এর উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানগত যুদ্ধের ময়দানে পুনরায় উদ্যোগ ফিরে পাওয়া—যে যুদ্ধে বহু বছর ধরেই পশ্চিম, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে এবং দুঃখজনকভাবে বহু জাতি এর মোকাবিলায় কেবল প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

ড. শহরিয়ার জরশানাসের ভাষায়, আজ আমরা এমন এক সভ্যতার মুখোমুখি, যা অতীতের সব সভ্যতা থেকে ভিন্ন। এই নতুন সভ্যতা অন্য সভ্যতাগুলোর সমান্তরালে অবস্থান করে না; বরং নিজেকেই—এবং কেবল নিজেকেই—সভ্যতা মনে করে এবং অন্য সভ্যতাগুলোকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। পশ্চিমা সভ্যতা নিজেকে পরিপক্ব ও উন্নত বলে মনে করে এবং অন্যদের পশ্চাৎপদ, আর সৌজন্য দেখালে ‘উন্নয়নশীল’ বলে আখ্যায়িত করে।

অব্যাহত বৈপরীত্যে পরিপূর্ণ এক সভ্যতা!

হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সাইয়্যেদা ফাতিমা সাইয়্যেদমুদাল্লিল কার বলেন, সর্বপ্রথম আমাদের পশ্চিমা সভ্যতার উপাদানগুলো ভালোভাবে চেনা প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, আজ পশ্চিমা সভ্যতা অসংখ্য বর্ণনা-নির্মাণ ও চিন্তা-নির্মাণকারী হাতিয়ারের মাধ্যমে—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, উপন্যাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত—মাঠ এমনভাবে নিজের নিয়মে সংজ্ঞায়িত করেছে যেন কেবল এক পক্ষেরই আক্রমণ ও প্রশ্ন করার অধিকার আছে, আর অপর পক্ষকে শুধু ব্যাখ্যা দিতে ও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হয়।

অথচ সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী, পশ্চিমা সভ্যতার মুখোমুখি হলে আমাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে হবে। অর্থাৎ প্রচলিত সন্দেহগুলোর জবাব দেওয়ার বাইরেও গিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি ও মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে হবে।

বাস্তবতা হলো, পশ্চিমা সভ্যতা তার গণমাধ্যমে যতই ঝলমলে ও আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপিত হোক না কেন, তা নানাবিধ বৈপরীত্য, নৈতিক সংকট, ঐতিহাসিক কলঙ্ক এবং কাঠামোগত বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—যেসব বৈপরীত্য আজও অব্যাহত। যে সভ্যতা নিজেকে মানবাধিকার রক্ষক বলে দাবি করে, তাকেই আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশবাদী অপরাধ, জাতিধ্বংস, সম্পদ ও খনিজ লুণ্ঠন, প্রক্সি যুদ্ধ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিষয়ে মানবজাতির কাছে জবাব দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা ও আমেরিকান সংস্কৃতি কীভাবে নারীর অধিকারের কথা বলতে পারে, যখন তার শিল্পব্যবস্থা নারীকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য, ভোগের উপকরণ ও বিজ্ঞাপনের বস্তুতে পরিণত করেছে এবং কার্যত পরিবার প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে?

পশ্চিমা সভ্যতার সাজানো আবরণ সরিয়ে দিতে হবে

সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী মাহদি মোলায়ি মনে করেন, আজ পশ্চিম ও আমেরিকার আধিপত্য ভাঙতে হলে আমাদের অবশ্যই পশ্চিমা সভ্যতার এই সাজানো মুখোশগুলো বর্তমান প্রজন্মের সামনে উন্মোচন করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা হলো—প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ পশ্চিমকে জবাবদিহি ও জিজ্ঞাসাবাদের আসনে বসানো। কারণ যে সভ্যতা নিজেকে নিখুঁত হিসেবে উপস্থাপন করে, তার বৈপরীত্যগুলোকে প্রশ্ন করা মানেই সেই একচেটিয়া বর্ণনার শেকল থেকে জাতির মনকে মুক্ত করার সূচনা, যা দশকের পর দশক ধরে বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান প্রজন্ম যে বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা বর্ণনার মুখোমুখি হচ্ছে তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পশ্চিম এমন সব বর্ণনা তৈরি করে যা অপরিহার্যভাবে সত্য নয়; কিন্তু সিনেম্যাটিক আকর্ষণ, শৈল্পিক চরিত্রায়ণ, প্রতারণামূলক সাহিত্যিক ফর্ম ও সুসজ্জিত উপস্থাপনার মাধ্যমে শ্রোতার মনে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি গেঁথে দেয়। যদি আমরা কেবল প্রচলিত প্রশ্ন ও সন্দেহের জবাব দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি, তাহলে সবসময়ই কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকব। প্রতিরক্ষা প্রয়োজন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্ট সংকটগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে

তিনি আরও বলেন, সভ্যতা কেবল আত্মরক্ষার মাধ্যমে টিকে থাকে না; বরং জ্ঞানগত আক্রমণের মাধ্যমে টিকে থাকে—নতুন ধারণা সৃষ্টি করে, নিজস্ব পরিভাষা ও শিল্পরীতি গড়ে তুলে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর চিন্তার মূর্তিগুলো ভেঙে দিয়ে। নৈতিকতার মূল শিরায় আঘাত হেনে, সাহসের সঙ্গে সেই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে, যেগুলো বহু বছর ধরে কেউ তুলতে সাহস করেনি।

অর্থাৎ পশ্চিমা সন্দেহের শুধু প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলে আমাদেরই প্রশ্নের নতুন ঢেউ শুরু করতে হবে—পশ্চিমে আধ্যাত্মিকতার সংকট, যৌন পরিচয়ের সংকট, পরিবার সংকট, লাগামহীন পুঁজিবাদের সংকট, একাকীত্বের সংকট, বর্ণবাদের সংকট, কাঠামোগত সহিংসতার সংকট, নব্য উপনিবেশবাদের সংকট এবং বিনোদন শিল্প থেকে সৃষ্ট মানবতাবিরোধী সংকট নিয়ে। এগুলোই সেই সভ্যতার দুর্বল দিক, যা নিজেকে মানবজাতির চূড়ান্ত সংস্করণ বলে দাবি করে।

আমিরুল মুমিনিন (আ.)-এর জীবন ও বাণী থেকে শিক্ষা

এই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-এর জীবনচর্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ন্যায় ও শালীনতার সঙ্গে কেবল সত্যের পক্ষে প্রতিরক্ষা করেননি; বরং শত্রু ও অহংকারী শক্তিগুলোকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। মুয়াবিয়ার উদ্দেশে লেখা তাঁর চিঠিগুলো এ বিষয়ের স্পষ্ট উদাহরণ।

নাহজুল বালাগার দশম পত্রে তিনি মুয়াবিয়াকে ‘পার্থিব লালসা ও বস্তুবাদ’ এবং ‘অযোগ্যদের সঙ্গে পরামর্শ’-এর জন্য তিরস্কার করেন এবং ‘ইসলামে উজ্জ্বল অতীতের অভাব’ ও ‘পারিবারিক মর্যাদাহীনতা’র বিষয়ে আক্রমণ করেন। একইভাবে পঁয়ষট্টিতম পত্রে তিনি মুয়াবিয়াকে সত্য থেকে পলায়ন, কাঠামোগত মিথ্যাচার এবং যোগ্যতা ছাড়া পদ দখলের বিষয়ে কঠোরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

তিনি যোগ করেন, গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, নাহজুল বালাগা জুড়েই শত্রু ও জালিমদের দুর্বলতার ওপর আমিরুল মুমিনিন (আ.)-এর আক্রমণ ও প্রশ্নে ভরপুর, এবং ‘জিহাদে তাবইন’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকই হলো এই মূল বিষয়ের প্রতি মনোযোগ।

প্রতিবেদন: সাইয়্যেদ মোহাম্মদ মাহদি মুসাভি

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha