হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম হাদী (আলাইহিস সালাম)-এর শাহাদাত উপলক্ষে আহলে বাইতের (আ.) দশম ইমামের মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর বক্তব্যের নির্বাচিত অংশ সম্মানিত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো—
ইমাম হাদীর (আ.) যুগে শিয়া মাজহাবের শক্তি ও বিজয়
ইমাম হাদী (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সমসাময়িক আব্বাসি খলিফাদের মধ্যকার সংগ্রামে— যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয় দিক থেকেই বিজয়ী ছিলেন, তিনি ছিলেন ইমাম হাদী (আ.) নিজেই। আমাদের সব বক্তব্য, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে এ বাস্তবতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা উচিত।
তাঁর ইমামতের সময়ে একে একে ছয়জন খলিফা ক্ষমতায় আসে এবং প্রত্যেকেই করুণ পরিণতির শিকার হয়। সর্বশেষ খলিফা মু‘তাজ ইমামকে শহিদ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেও মৃত্যুবরণ করে। এই খলিফাদের অধিকাংশই লাঞ্ছনাকর পরিণতিতে প্রাণ হারায়—কেউ নিজের পুত্রের হাতে, কেউ ভাতিজার হাতে। এভাবেই বনু আব্বাস ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়; অথচ এর সম্পূর্ণ বিপরীতে শিয়া দিন দিন বিস্তৃত ও শক্তিশালী হতে থাকে।
সামারা: একটি সামরিক নগরীতে ইমামের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম
ইমাম হাদী (আ.) মোট ৪২ বছর জীবন লাভ করেন, যার মধ্যে প্রায় ২০ বছর তিনি সামারায় অবস্থান করেন। সেখানে তাঁর কৃষিজমি ছিল এবং তিনি স্বাভাবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনা করতেন।
সামারা মূলত একটি সামরিক নগরী ছিল, যা খলিফা মু‘তাসিম প্রতিষ্ঠা করে। সে তুর্কিস্তান, সমরকন্দ, মঙ্গোলিয়া ও পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে আনা তুর্কি দাস সেনাদের সেখানে বসবাস করায়— যাদের আমাদের আজারবাইজানি তুর্কিদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।
এই সেনারা সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং ইসলামের গভীর শিক্ষা, ইমামদের মর্যাদা কিংবা মুমিনদের অধিকার সম্পর্কে অবগত ছিল না। ফলে তারা সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাগদাদের আরব জনগণের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
গোপন সংগঠন ও বিশ্বব্যাপী শিয়া নেটওয়ার্ক
এই সামারাতেই ইমাম হাদী (আ.)-এর যুগে বহু শিয়া মনীষী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব একত্রিত হন। ইমাম তাঁদের অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা করেন এবং পত্রালাপসহ নানাবিধ উপায়ে ইমামতের বার্তা সমগ্র ইসলামি বিশ্বে পৌঁছে দেন।
কোম, খোরাসান, রেই, মদিনা, ইয়েমেনসহ দূরবর্তী অঞ্চলে শিয়াদের যে সুদৃঢ় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, তা এই সংগঠিত ব্যবস্থারই ফল। এর মাধ্যমে শিয়া মতাদর্শের অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এই সব কার্যক্রম ইমাম হাদী (আ.) সম্পন্ন করেছেন ছয়জন নির্মম ও রক্তপিপাসু খলিফার ধারালো তরবারির ছায়ায়—তাদের কঠোর নজরদারি ও শত্রুতার মধ্যেই।
এক দিনের সংগ্রাম—বহু বছরের প্রভাব
ইমাম হাদী (আ.)-এর ওফাত সম্পর্কে বর্ণিত একটি প্রসিদ্ধ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর ইন্তেকালের সময় সামারায় বিপুলসংখ্যক শিয়া উপস্থিত ছিলেন—যাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত খিলাফতের গোয়েন্দা যন্ত্র শনাক্ত করতে পারেনি। কারণ তারা এমন এক শক্তিশালী ও গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, যার নাগাল শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এই মহান ইমামদের এক দিনের সংগ্রাম বহু বছরের কর্মযজ্ঞের সমান প্রভাব ফেলত। তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমেই দ্বীন সংরক্ষিত ছিল। নচেৎ এমন শাসকদের অধীনে—যাদের শীর্ষে ছিল মুতাওয়াক্কিল, মু‘তাজ, মু‘তাসিম ও মামুন এবং যাদের দরবারি আলেমদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনে আকসামের মতো প্রকাশ্য পাপাচারী ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত ছিল—এই দ্বীনের অস্তিত্ব টিকে থাকাই সম্ভব হতো না।
এই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ কেবল শিয়াবাদ নয়, বরং কুরআন, ইসলাম ও দ্বীনি জ্ঞানকেও সংরক্ষণ করেছে। এটাই আল্লাহর খাঁটি, মুখলিস ও নির্বাচিত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।
বক্তব্য: ৩০/০৫/১৩৮৩ ফার্সি সন (২০ আগস্ট ২০০৪)
জিয়ারাতে জামিয়া কাবিরা—ইমাম হাদীর (আ.) অমর উত্তরাধিকার
আহলে বাইত (আলাইহিমুস সালাম) থেকে প্রাপ্ত অসংখ্য বরকতময় ঐতিহ্যের মধ্যে জিয়ারাতে জামিয়া কাবিরা একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী স্থান অধিকার করে আছে। এই জিয়ারতের মাধ্যমে ইমামদের মর্যাদা, মাকাম ও বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত পূর্ণতা, গভীরতা ও সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
এই মহিমান্বিত জিয়ারতটি ইমাম হাদী (আ.)-এর শিক্ষা। একইভাবে, ঈদে গাদিরের দিনে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর জিয়ারত—যা আহলে বাইতের বাণীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন—তাও তাঁরই শিক্ষা।
আমরা আশা করি, এই মহান ইমামের স্নেহময় ও করুণাময় দৃষ্টির বরকতে—যাঁর শাহাদাত বছরের প্রথম দিন ও নওরোজের সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে—ইরানের জনগণ এ বছর আল্লাহ তাআলার বিশেষ হেদায়েত ও অনুগ্রহ লাভ করবেন।
বক্তব্য: ০১/০১/১৩৯৭ ফার্সি সন (২১ মার্চ, ২০১৮)
আপনার কমেন্ট