হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিফটিং এমন এক পদ্ধতি, যার অনুসারীরা দাবি করেন—এর মাধ্যমে নিজের পছন্দের এক মানসিক জগতে ‘ভ্রমণ’ করা সম্ভব। তবে এই দাবি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, এ ধরনের পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা ক্ষতিকর হতে পারে এবং মানুষকে বাস্তবতা অনুধাবন ও তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
একটি সহজ উদাহরণ
ভাবুন, আপনি একজন শিক্ষার্থী— দিনটা কেটেছে ক্লাস, যানজট, আর্থিক চাপ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। রাতে ফোনটা পাশে রেখে বললেন, “মাত্র দশ মিনিট।” চোখ বন্ধ করলেন, শ্বাস শান্ত করলেন, আর কল্পনায় গড়ে তুললেন এক দৃশ্য—যেখানে সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে; প্রিয় মানুষগুলো পাশে; আপনার কথা শোনা হচ্ছে; দৈনন্দিন বাস্তবতার ভয়গুলো সেখানে ঢুকতে পারে না।
আপনি কল্পনায় এতটাই ডুবে গেলেন—গন্ধ, শব্দ, আলো, পোশাক, হাঁটার পথ—সব এত স্পষ্ট হয়ে উঠল যে মনে হলো, “আমি সত্যিই সেখানে আছি।” শুধু কল্পনা নয়, যেন আরেকটি জীবন ছুঁয়ে দেখছেন। এই জায়গা থেকেই শুরু হয় শিফটিং নিয়ে আলোচনা।
শিফটিং কী?
শিফটিং বলতে বোঝায়—মনোযোগ, কল্পচিত্রায়ন ও বিভিন্ন মানসিক কৌশলের সাহায্যে এক ভিন্ন ‘বাস্তবতা’ অনুভব করার চেষ্টা; যেখানে ব্যক্তি মনে করেন, তিনি বর্তমান জগৎ থেকে ‘সরে গিয়ে’ আগে থেকে পরিকল্পিত এক মানসিক জগতে প্রবেশ করেছেন।
কারও কাছে এটি তীব্র এক মানসিক ভ্রমণের মতো; আবার কারও বিশ্বাস— তিনি সত্যিই এক পৃথক বাস্তবতায় স্থানান্তরিত হন।
মূলধারার মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এসব অভিজ্ঞতা সাধারণত চেতনার পরিবর্তিত অবস্থার কাছাকাছি—যেমন ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থা, বা নির্দেশিত কল্পনায় ডুবে গিয়ে বাস্তব অনুভূতির ভ্রম তৈরি হওয়া।
শিফটিংয়ের উৎস ও প্রেক্ষাপট
আধুনিক অর্থে শিফটিং মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছে— যেখানে ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো নামকরণ ও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি পরিচিত প্রবাহে রূপ নেয়। এর বিস্তারে কয়েকটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে—
১. সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ফলের প্রতিশ্রুতিমূলক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের প্রসার
২. মনোযোগ, শ্বাস-প্রশ্বাস, মেডিটেশন ও মানসিক কল্পচিত্রায়নের প্রতি আগ্রহ
৩. কল্পকাহিনি ও ফ্যান্টাসি জগতের প্রতি ভক্তি
৪. ঘুম ও জাগরণের সীমান্তবর্তী অভিজ্ঞতার রোমান্টিক বর্ণনা
কারা এতে বেশি আকৃষ্ট হন?
১. কিশোর ও তরুণরা: কল্পনা, পরিচয় নির্মাণ ও বাস্তব চাপ থেকে মুক্তির তাগিদ প্রবল থাকে
২. প্রখর কল্পনাশক্তির মানুষ: যারা সহজেই মানসিক চিত্র গড়ে তুলতে পারেন
৩. নিয়ন্ত্রণহীনতায় ক্লান্ত ব্যক্তিরা: নির্মিত এক ‘নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতা’ নিরাপত্তাবোধ দেয়
৪. গল্প ও কল্পজগতের অনুরাগীরা: যারা প্রিয় চরিত্রের জগতে ‘বাস’ করতে চান
অনেকের জন্য শিফটিং নিছক বিনোদন নয়; বরং নিয়ন্ত্রণ, অর্থবোধ, স্বীকৃতি বা প্রশান্তির ঘাটতির মানসিক প্রতিক্রিয়া।
সমস্যা, ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা
বাইরে থেকে শিফটিংকে শিথিলতা বা নির্দেশিত কল্পনার মতো মনে হলেও, সমস্যার শুরু হয় এর গোপন প্রভাব থেকে।
বাস্তবতা থেকে স্থায়ী পলায়নের ঝুঁকি
চাপ এলেই যদি কেউ সমস্যা সমাধানের বদলে বিকল্প জগতে আশ্রয় নেয়, মস্তিষ্ক শেখে— সমস্যা সমাধান করো না, এড়িয়ে যাও। ফলাফল: কাজ ও পড়াশোনায় ভাটা, বাস্তব জীবনে উদ্বেগ আরও বেড়ে যাওয়া।
ঘুম ও দৈনন্দিন ছন্দের ব্যাঘাত
ঘুমের সময় অতিরিক্ত অনুশীলন, দীর্ঘ জাগরণ বা ‘আজই ঘটতেই হবে’— এই চাপ অনিদ্রা, খণ্ডিত ঘুম ও দিনের ক্লান্তি ডেকে আনতে পারে।
অবসেশন ও ব্যর্থতার বোধ
অভিজ্ঞতা ‘সম্পূর্ণ’ না হলে আত্মদোষারোপ—“আমার মনোযোগ কম,” “বিশ্বাস যথেষ্ট নয়”—এটি স্বস্তির বদলে উদ্বেগ ও আত্মগ্লানিতে রূপ নিতে পারে।
মানসিকভাবে সংবেদনশীলদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সীমা
যাদের তীব্র উদ্বেগ, গভীর বিষণ্নতা, বাস্তবতা-বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা বা মনোরোগের উপসর্গ আছে— তাদের ক্ষেত্রে কল্পনা ও বাস্তবতার সীমা ঝাপসা করা অনুশীলন ক্ষতিকর হতে পারে। এখানে প্রশ্ন বিশ্বাসের নয়; প্রশ্ন মানসিক স্বাস্থ্য ও বাস্তবতার সীমারক্ষা।
আশার অর্থনীতি’ ও অপব্যবহার
যেখানে আশা বেশি, সেখানে বাজারও গড়ে ওঠে— কোর্স, প্যাকেজ, কোচিং, অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি। ব্যক্তিগত ও অস্পষ্ট অভিজ্ঞতা পণ্যে রূপ নিয়ে মানুষের আবেগকে পুঁজি করার ঝুঁকি তৈরি হয়।
সত্যের সঙ্গে নীরব সংঘাত
কিছু বয়ান ইঙ্গিত দেয়—পারোনি মানে বিশ্বাস কম,” বা “সব সম্ভব, কোনো সীমা বাস্তব নয়। নিয়ন্ত্রণহীন হলে এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে জীবনের মৌলিক সত্য—প্রচেষ্টা, সময়, সীমাবদ্ধতা ও দায়িত্ব—থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
শিফটিং আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়া ও মানসিক সীমারেখা ছাড়া এটি প্রশান্তির বদলে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতার পথ খুলে দিতে পারে। কল্পনা হোক সৃজনের শক্তি— পলায়নের ঠিকানা নয়।
অনুবাদ: ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন
আপনার কমেন্ট