হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, কোমের খাতামুল আম্বিয়া (সা.) মাদরাসার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাতে আয়াতুল্লাহ আলিরেজা আরাফি এই প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক, শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি, সভ্যতামুখী দৃষ্টিকোণ, বৈজ্ঞানিক গভীরতা, বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা ও সংগ্রামী চেতনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
হাওজা ইলমিয়ার পরিচালক হাওজাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখার বিষয়ে কিছু উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বলেন, কখনো কখনো এমন ধারণা তৈরি হয় যে হাওজাকে শুধু মাদরাসা পরিচালনা, স্তর বিন্যাস বা প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেখা হয়। যদিও এগুলো প্রয়োজনীয় ও সম্মানজনক, কিন্তু হাওজা এসবের চেয়েও অনেক বৃহত্তর। লক্ষ্যসমূহের উচ্চতা, উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব এবং সমকালীন যুগের বিপুল চাহিদা ও বাস্তবতা এমন যে, সেই উচ্চ শিখরের তুলনায় যেকোনো উদ্যোগই ক্ষুদ্র বলে মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, একজন তরুণ তালেবে ইলম যদি শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই এসব উচ্চ লক্ষ্য ও বিস্তৃত দিগন্ত নিয়ে চিন্তা করে, তবে সেটাই হাওজার ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য শর্ত। অবশ্যই এই উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গভীর জ্ঞানচর্চা, বাস্তব কাজে দক্ষতা, প্রজ্ঞা, সাহস ও আল্লাহর পথে সংগ্রামের চেতনা যুক্ত না হলে তার প্রকৃত ফল প্রকাশ পায় না।
আয়াতুল্লাহ আরাফি খাতামুল আম্বিয়া (সা.) মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি শিক্ষকদের স্ত্রী ও পরিবারবর্গের ভূমিকারও প্রশংসা করেন এবং হাওজার বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষামূলক সাফল্যে তাঁদের অবদানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।
তিনি প্রস্তাব দেন যে শহীদ আয়াতুল্লাহ বাকির সদর-এর সহধর্মিণীর সঙ্গে নেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার নিয়ে রচিত “সবরের রঙে” (به رنگ صبر) বইটি উপস্থিত নারী সদস্যদের জন্য সরবরাহ করা হোক এবং শহীদ সদরের ব্যক্তিত্বকে পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানার জন্য এ গ্রন্থ অধ্যয়নের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
হাওজা ইলমিয়ার পরিচালক শহীদ আয়াতুল্লাহ সৈয়দ মুহাম্মদ বাকির সদর-এর বৈজ্ঞানিক, নৈতিক ও বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে বলেন, শহীদ সদর ৪৭ বা ৪৮ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন; কিন্তু আজ কোম, নাজাফ, মাশহাদসহ বিভিন্ন হাওজা ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রে বহু উচ্চস্তরের পাঠে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ ইজতিহাদের অধিকারী একজন মুজতাহিদ—এটি কেবল প্রাচীন ধারার ইজতিহাদ নয়, বরং সমকালীন জটিল ফিকহি ও উসূলি ধারণা অনুধাবনের উপযোগী ইজতিহাদ। বলা হয়, তিনি প্রায় ১৫ বছর বয়সেই পূর্ণ ইজতিহাদে পৌঁছান এবং ৩০ বছরের আগেই দর্শন ও অর্থনীতিতে স্থায়ী প্রভাব বিস্তারকারী গ্রন্থ রচনা করে গোটা ইসলামী বিশ্বকে নাড়িয়ে দেন।
তিনি যোগ করেন, দর্শন, অর্থনীতি ও যুক্তিবিদ্যায় শহীদ সদরের রচনাসমূহ বস্তুবাদ, উদারবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো মতবাদের বিরুদ্ধে এক বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে এবং নাজাফে পরিবর্তন আনার আগেই বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়, বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র এবং কোম হাওজাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এসব রচনা তাঁর বিবাহের আগেই লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বৈজ্ঞানিক বিনয় এতটাই গভীর ছিল যে, বই প্রকাশের সময় তিনি নিজের নাম না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। পরে যখন বইয়ের ওপর নিজের নাম দেখেন, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন তাঁর কাজে প্রবেশ না করে—এই ভয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন।
আয়াতুল্লাহ আরাফি শহীদ সদরের বিরল প্রতিভার পাশাপাশি তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের কথাও উল্লেখ করে বলেন, প্রতিভা কখনোই শ্রম ও প্রচেষ্টার বিকল্প হতে পারে না। শহীদ সদর ছিলেন প্রতিভা ও বৈজ্ঞানিক সংগ্রামের অনন্য সংমিশ্রণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির ধারা প্রমাণ করে যে, নিরন্তর পরিশ্রম ছাড়া বৈজ্ঞানিক মহত্ত্ব অর্জিত হয় না।
তিনি শহীদ সদরের “হালাকাত” গ্রন্থকে উসূলশাস্ত্রের পাঠ্যবইয়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বৈজ্ঞানিক গভীরতা ও প্রগাঢ়তা বজায় রেখেই আমরা হাওজার পাঠ্যবই ও শিক্ষা-ব্যবস্থায় রূপান্তরের পক্ষে।
পরিশেষে আয়াতুল্লাহ আরাফি ইসলামী বিপ্লবের সঙ্গে শহীদ সদরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে বলেন, শহীদ সদর ছিলেন এক প্রতিভাবান আরব চিন্তাবিদ; ইরান বা কোম হাওজার সঙ্গে তাঁর কোনো বিশেষ জাতিগত বা ভৌগোলিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তাঁর ব্যক্তিত্বে এক গভীর পরিবর্তন আসে। তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন ইসলামী বিপ্লব কী এবং এটিকে নবী ও আল্লাহর ওলিদের ঐতিহাসিক আদর্শের বাস্তব রূপ হিসেবে দেখেছিলেন। ইমাম খোমেনি (রহ.) ও ইসলামী বিপ্লবের প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন বিসর্জনের কারণ হয়।
আয়াতুল্লাহ আরাফি সাদ্দাম বা'আস সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ সদরকে ইসলামী বিপ্লবের সমর্থন ত্যাগ করার প্রস্তাবের ঘটনাও উল্লেখ করে বলেন, শহীদ সদর ইমামের নাম বা ইসলামী বিপ্লব থেকে একচুলও পিছু হটতে রাজি হননি, এবং শেষ পর্যন্ত এই দৃঢ়তাই তাঁকে শাহাদাতের পথে নিয়ে যায়। এটি ইসলামী বিপ্লবের মহত্ত্বেরই প্রমাণ, যা এমন মহান ব্যক্তিত্বদের আকৃষ্ট করেছিল।
আপনার কমেন্ট