হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.)-এর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের মর্যাদা তাঁর জীবদ্দশাতেই অত্যন্ত বিশিষ্ট ছিল। তাঁর দরবার সবসময় জ্ঞানপিপাসু ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পূর্ণ থাকত। ছোটবেলায়ই তাঁকে "জ্ঞান-বিশ্লেষক" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল এবং তিনি তাঁর সময়ের পণ্ডিত ও বিদ্বানদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন।
ياَ باقِرَ الْعِلْمِ لاَهْلِ التُّقى
وَ خَيْرَ مَنْ لَبّى عَلَى الاَجْبُلِ
বাকের: জ্ঞানের বিশ্লেষক
ফুসুল আল-মুহিম্মা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল কারণ তিনি জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতেন এবং তা বিশ্লেষণ করতেন। সাহাহ-এ বলা হয়েছে: "তাবাক্কুর" মানে জ্ঞানের বিস্তৃতি। কামুস গ্রন্থে বলা হয়েছে যে মুহাম্মাদ ইবনে আলি ইবনে হুসাইন (আ.)-কে "বাকের" বলা হত, কারণ তিনি জ্ঞানের গভীরে পারদর্শী ছিলেন। লিসান আল-আরব-এও উল্লেখ রয়েছে যে, তাঁকে "বাকের" বলা হত কারণ তিনি জ্ঞানের বিশ্লেষণ করে মূল উৎসে পৌঁছাতেন এবং শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি করতেন।
ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.)-এর জ্ঞান এমনভাবে বিস্তৃত ছিল যে, আরবি ভাষায় তাঁকে "বাকের" বলা হত। "বাকের" বলতে বোঝানো হয় সেই ব্যক্তি, যিনি জ্ঞানকে ভেঙে ফেলে তা বিশ্লেষণ করেন এবং তা প্রসারিত করেন। আরবিতে "তাবাক্কুর" অর্থ "বিস্তৃতি"।
ইবনে হাজারের বর্ণনা:
ইবনে হাজার তাঁর সাওয়াইক আল-মুহরিকা গ্রন্থে লিখেছেন: ইমামকে "বাকের" বলা হত। "বাকের" শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো "ভূমি চাষের মতো মাটিকে খনন করা এবং তার ভেতরের গুপ্ত ধন বের করে আনা"। ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছেন।
ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য:
জাবির জুফি, যিনি ইমামের একজন প্রধান ছাত্র, তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন ইমামকে "বাকের" বলা হয়। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, "কারণ তিনি জ্ঞানকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং প্রকাশ করেছেন, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।"
ইমামের জ্ঞান এতটাই প্রসারিত ছিল যে তাঁর খ্যাতি ইসলামি বিশ্বের দূর-দূরান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি খোরাসানের লোকেরাও তাঁর পাঠে যোগ দিতেন এবং তাঁদের জটিল প্রশ্নের উত্তর পেতেন।
মুহাম্মাদ ইবনে মুনকারের মন্তব্য:
সুন্নি পণ্ডিত মুহাম্মাদ ইবনে মুনকার বলেন:
"আমি বিশ্বাস করতাম না যে আলী ইবনে হুসাইন (আ.) এমন একজন সন্তান রেখে গেছেন, যিনি তাঁর মতোই জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে আলি (আ.)-কে দেখে আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। আমি তাঁকে উপদেশ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন।"
আবদুল্লাহ আত্তার মন্তব্য:
আবদুল্লাহ আত্তা বলেন: "আমি কখনও পণ্ডিতদের এতটা গুরুত্বহীন মনে করিনি, যতটা মুহাম্মাদ ইবনে আলি (আ.)-এর সামনে। এমনকি হাকাম ইবনে উতাইবাকেও তাঁর সামনে শিশুর মতো মনে হত, যে তার শিক্ষকের সামনে বসে আছে।"
ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) সম্পর্কে বর্ণনা ও তাঁর মূল্যবান বক্তব্য
মক্কায় এক অসাধারণ ঘটনা
হাব্বাবা ও আল-বাইহা বর্ণনা করেন যে, এক বিকেলে মক্কার কাবাঘরের দরজার কাছাকাছি এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তাঁর চারপাশে মানুষ ভিড় করেছিল, তাঁরা জটিল সমস্যার সমাধান চাইছিলেন এবং নানা প্রশ্ন করছিলেন। তিনি সেখান থেকে উঠলেন না যতক্ষণ না হাজারো সমস্যার সমাধান দিয়ে ফতোয়া প্রদান করেন। এরপর তিনি চলে গেলেন। একজন ঘোষক উচ্চ স্বরে ঘোষণা করলেন: انَّ هذا النّورُ الاَبْلَجُ المُسَرَّجُ وَ النَّسيمُ الاَرِجُ وَ الْحَقُّ الْمَرِجُ؛
"এই হল সেই উজ্জ্বল আলোকরশ্মি, যা সঠিক পথ দেখায়; এই হল সেই সুমধুর সুবাস, যা বিশ্বকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সৌরভে ভরিয়ে দেয়; এই হল সেই ন্যায়, যার মূল্যমান মানুষ অবহেলিত করেছে।"
লোকে প্রশ্ন করল: "এই মহান ব্যক্তি কে?" উত্তরে বলা হল: মুহাম্মাদ ইবনে আলি বাকের (আ.), যিনি জ্ঞানের গভীরতা উন্মোচনকারী এবং ইমাম আলি (আ.) ও তাঁর বংশধরদের উত্তরাধিকারী।
ইবনে শহরে আশুবের বক্তব্য
ইবনে শহর আশুব উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম বাকের (আ.)-এর মতো বিশ্লেষণী দক্ষতা ও গভীরতা হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)-এর অন্য কোনো বংশধরের মধ্যে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মাধ্যমে তাফসির, কথাবার্তা, ফতোয়া, হালাল-হারামের বিধান, এবং ইসলামের গভীর জ্ঞানের বিস্তার ঘটেছে।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারীর সাক্ষাৎ
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি, রাসুল (সা.)-এর একজন সাহাবি, মদিনার মসজিদে বসে বারবার বলতেন: ( يـا بـاقـِرُ يـا بـاَقـِرَ الْعـِلْمِ ) "ইয়া বাকের, ইয়া বাকের আল-ইলম!"
লোকেরা বলত, "জাবির বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন।" জাবির উত্তরে বলতেন, "সর্বশক্তিমান আল্লাহর শপথ, আমি পাগল নই। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে শুনেছি:
'হে জাবির, তুমি আমার বংশের এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ করবে, যার নাম আমার নামের মতো হবে, যার চেহারা আমার চেহারার মতো হবে, এবং যিনি জ্ঞানকে ভেঙে বিশ্লেষণ করবেন।'
এই ভবিষ্যদ্বাণী আমাকে যা বলছি তা বলাতে বাধ্য করেছে।"
ইমাম বাকের (আ.)-এর মূল্যবান উক্তি
১. "প্রতিটি জীব, এমনকি সাগরের মাছও জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য দোয়া করে।" (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৩৭)
২. "যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে জ্ঞান অর্জন করে, সে শিক্ষাদানের সওয়াব পাবে এবং এর চেয়ে বড় মর্যাদা লাভ করবে। জ্ঞানীদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করো এবং তোমার ভাইদের সেই জ্ঞান শেখাও, যেমন তারা তোমাকে শিখিয়েছে।"
৩. "যে জ্ঞান অর্জন করে শুধুমাত্র অহংকার করার জন্য, মূর্খদের হেয় করার জন্য, অথবা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, তার স্থান জাহান্নামের আগুনে।"
৪. "আমি অপছন্দ করি যে কেউ তার জ্ঞানের চেয়ে বেশি কথা বলে।"
৫. "একজন মুমিনের নৈতিকতায় চাটুকারিতা ও ঈর্ষা থাকতে পারে না, তবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের ক্ষেত্রে এসব বৈধ।"
মজিদুল ইসলাম শাহ
আপনার কমেন্ট