হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতাপপুর দরবার শরীফের দুই দিন ব্যাপী ঐতিহাসিক ঈসালে সওয়াবের মূল বিষয় ছিল ইসলামের আলোকে তাসাউফের ব্যাখ্যাদান। সেই বিষয়টিকে সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন ঈসালে সওয়াবে উপস্থিত বক্তারা।
তাসাউফ আর সুফিবাদ সমার্থক শব্দ। সেই সুফিবাদের অন্যতম পীঠস্থান হল প্রতাপপুর দরবার শরীফ। এই দরবার শরীফে বহু বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ঈসালে সওয়াব। হজরত শাহ সুফি দিওয়ান জাফর রহ. এর স্মরণে এই ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রতাপপুর দরবার শরীফে। হজরত দিওয়ান জাফর রহ. ছিলেন প্রতাপপুর দরবার শরীফের খানকাহের প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমান পির হুজুর কেবলা সৈয়দ খালেদ আলী আল হোসাইনী সাহেবের পূর্ব পুরুষ। এই বাংলায় ইসলাম প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। সুফি তরিকার মধ্যে দিয়ে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে অসংখ্য মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুফিবাদের ধারক এবং বাহক এমন একটি মানুষের স্মরণে প্রতাপপুর দরবার শরীফে প্রতিবছর দুই দিন ধরে ঈসালে সওয়াব অনুষ্ঠিত করেন তাঁর অধস্তন অর্থাৎ উত্তরপুরুষ পিরজাদা সৈয়দ রুহুল আমিন ভাইজান। সেখানে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা ইসলামি ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানান তিনি। এবারেও ভাইজানের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিতরা উপস্থিত হয়ে পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহের অলোকে তাসাউফের ব্যাখ্যা করেন।
সুফিবাদ কোনও সামান্য বিষয় নয়। তাই সুফিবাদকে জানতে হলে কামেল পিরের দরবারে আসতে হবে। বুঝতে হবে এর মর্মার্থ। হজরত আব্দুল কাদের জিলানী রহ. থেকে শুরু করে খাজা মঈনুদ্দীন চিস্তি রহ., নিজামুদ্দিন আউলিয়া রহ., কুতুবুদ্দিন কাকী রহ. সহ অসংখ্য কামেল পির ছিলেন যাঁরা সুফিবাদের প্রচার করে গিয়েছেন আজীবন। তাঁদের অন্তর শীতল করা আহ্বানে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তারপর তাঁরা নিজেরাও সুফিবাদকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের কোণে কোণে। প্রতাপপুর দরবার শরীফও সেই ধারারই শরিক। হজরত দিওয়ান জাফর রহ. যে ভাবে সুফিবাদের সূচনা করে গিয়েছিলেন, সেই কাজকেই আরও বিস্তৃতি দিয়েছেন তাঁর বর্তমান বংশধর হুজুর কেবলা সৈয়দ খালেদ আলী আল হোসাইনী পির সাহেব এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি তথা অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পিরজাদা সৈয়দ রুহুল আমিন ভাইজান। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠার ফলেই প্রতাপপুর দরবার শরীফ হয়ে উঠেছে বাংলায় সুফিবাদ চর্চার অন্যতম তীর্থক্ষেত্র এবং মানুষে মানুষে মহামিলনের পুণ্যভূমি।
ঠিক এই কথাগুলোই উঠে এল উপস্থিত বক্তাদের বক্তব্যে। যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়— তাসাউফ হল ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। এই দর্শন আসলে আত্মার পরিশুদ্ধির দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি মাধ্যমে। ফলত এই তাসাউফকে আত্মার বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাসাউফের মাধ্যমেই মুমিনরা নিজেদের আত্মিক উন্নতি করতে পারেন। তাসাউফের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো হল—
১. তাসাউফের মূল উদ্দেশ্য হল আত্মার পরিশুদ্ধি।
২. তাসাউফের মাধ্যমে মুমিনরা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
৩. একমাত্র তাসাউফের মাধ্যমে মুমিনরা নফসের ধোঁকা ও শয়তানের কবজা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন।
৪. তাসাউফ অর্থাৎ সুফিবাদ মুমিনকে ইসলামের সরল পথে পরিচালনা করে।
৫. তাসাউফের সাধনায় নিজেকে সমর্পিত ব্যক্তিকে সুফি বলা হয়।
৬. সুফি ঐতিহ্যে গুরুকে পির ও শিষ্যকে মুরিদ বলা হয়।
সুফিবাদের সঙ্গে আধুনিকতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই। আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় সুফিবাদ আজ প্রতিষ্ঠিত রুপ পেয়েছে। ফলে সুফিবাদ ছাড়া সর্বজনীন ঐক্য অসম্ভব। এই সুফিবাদ বা তাসাউফ হল মরমিতত্ত্বের সাধনায় জীবনকে নিয়োজিত করা। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, ইসলামি পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।
তাসাউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধ সাধনাকে বোঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান) ও ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হওয়া) লাভ করা যায়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অদৃশ্য এবং নিরাকার। তাঁর মধ্যে 'ফানা' হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই হল একমাত্র মাধ্যম। সুফিসাধকদের উপলব্ধি অনুযায়ী এই সাধনাকে তরিকত, অর্থাৎ আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। এই সাধনায় একজন পথপ্রদর্শক হলেন মুর্শিদ। সেই মুর্শিদকে ধরে একটা পর্যায়ের সুফিরা লাভ করেন বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। এই সময় তাঁরা হয়ে যান আল্লাহর পরম বন্ধু। বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সা. বলেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা...তখন আমি তার ওই কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার ওই চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার ওই হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার ওই পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে...'।" (হাদিসে কুদসি, বুখারি)
সুফিবাদের গূঢ় তত্ত্ব বোঝার জন্য যেতে হবে সুফিচর্চার কেন্দ্রভূমিতে। যেতে হবে পিরের সান্নিধ্যে। তবেই তাসাউফকে অন্তরে ধারণ করা যাবে। যে তাসাউফ আল্লাহ এবং তাঁর রসুল সা.-এর কথা বলে, সরল পথে চলার কথা বলে। আর এইসব জানার সুযোগ তৈরি হয় প্রতাপপুর দরবার শরীফের দুদিন ব্যাপী ঐতিহাসিক ঈসালে সওয়াবে। এখানেই এই ঈসালে সওয়াবের গুরুত্ব, এখানেই হুজুর কেবলা এবং সৈয়দ রুহুল আমিন ভাইজানের কৃতিত্ব।
আপনার কমেন্ট