হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,
ভূমিকা
আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ দিলদার আলী নাকভি নসীরাবাদি (র.)-যিনি গুফরান মা'আব নামে সমধিক পরিচিত-অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে উপমহাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় শিয়া আলেম ছিলেন। তাঁর ফিকহি, কালামী ও জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ড উপমহাদেশে শিয়া মাযহাবকে এক সুদৃঢ় বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত প্রদান করে এবং নতুন একটি চিন্তাধারার যুগের সূচনা করে। তাঁকে একজন বড় মুজতাহিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তিনি তাঁর শিক্ষাদান, গ্রন্থরচনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উপকৃত করেছেন।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
হযরত গুফরান মা'আব (র.) হুসাইনি সাদাত বংশের একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জ্ঞানচর্চার শুরু হয় তাঁর নিজ শহর নসীরাবাদ থেকে। প্রাথমিকভাবে তিনি ধর্মীয় মৌলিক শিক্ষা, ফারসি ও আরবি সাহিত্য এবং ফিকহ ও উসূলে পড়াশোনা করেন। শৈশব থেকেই পিতামাতার পরহেযগার জীবন দেখে তিনি ফিকহ ও কালামের দিকে গভীর মনোযোগী হন।
উচ্চতর বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ
জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তিনি ইরাকের পবিত্র নগরী নাজাফ ও কারবালায় গমন করেন। সেখানে তিনি সমসাময়িক বড় বড় আলেমদের সাহচর্যে গভীর জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধাবন লাভ করেন। বিশেষত, মরহুম আয়াতুল্লাহ বাহবাহানি ও আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মাহদী তাবাতাবায়ীর মতো মনীষীদের কাছ থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন এবং একটি শক্তিশালী মুজতাহিদী মর্যাদা অর্জন করেন।
বৈজ্ঞানিক অবদান
১. ইজতিহাদ ও ফিকহ:
হযরত গুফরান মা'আব (র.) উপমহাদেশে ইজতিহাদ প্রতিষ্ঠার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করেন। তিনি তাকলীদের পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর চিন্তা ও প্রশ্নমুখী মনোভাবকে উৎসাহ দেন। তাঁর ফিকহি মতামত ইজতিহাদী মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা তাঁর যুগের সমস্যার আধুনিক সমাধান প্রদান করত।
২. রচনাসমূহ:
তাঁর গ্রন্থাবলি জ্ঞানের ভাণ্ডারে অমূল্য সংযোজন। তাঁর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রচনা “শরহে তাজরীদুল আকা’ইদ” — যা ঈমান ও আকীদার বিষয়ে অসাধারণ বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি উসূলে ফিকহ, কালাম, দর্শন ও নৈতিকতা বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেন, যেগুলি আজও মাদ্রাসাগুলিতে পাঠ্য।
৩. মাদরাসায়ে নসীরিয়া প্রতিষ্ঠা:
লখনউ-এ তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা “নাসীরিয়া” উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শিয়া শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখান থেকে উপকৃত হন এবং পরবর্তীকালে উপমহাদেশে শিয়াবাদের বিস্তারে ভূমিকা রাখেন।
৪. তাবলিগ ও দাওয়াহ:
তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকৃত দ্বীনের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বক্তৃতা ও লেখনী ছিল সমাজে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার। তিনি ধর্মীয় সমাবেশ, মজলিস ও পাঠশালার মাধ্যমে শিয়া আকীদা ও শিক্ষাকে সুসংহতভাবে তুলে ধরেন।
বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা ও ইজতিহাদী দক্ষতা:
তিনি ইজতিহাদের ক্ষেত্রে গভীর দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। তিনি তাকলীদের প্রচলনকে চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী রূপে রূপান্তর করেন, যাতে ইসলামকে আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে আরো ফলপ্রসূভাবে উপস্থাপন করা যায়।
পরহেযগারি ও সংযম:
তাঁর জীবন ছিল তাকওয়া ও আত্মসংযমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি দুনিয়াবি ঝামেলা থেকে দূরে থেকে সর্বস্ব দ্বীনের খিদমতে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর চরিত্র ও ব্যবহার বহু মানুষকে প্রভাবিত করেছে।
শিক্ষাদান ও ব্যক্তিত্ব গঠনে অবদান:
তিনি হাজারো শিক্ষার্থী গড়ে তুলেছেন, যারা নিজ নিজ এলাকায় দ্বীনি বিপ্লবের প্রবর্তক হয়েছেন। তাঁর শিক্ষাদান ছিল কেবল জ্ঞান নয়, বরং আদর্শিক মানুষ গড়ার এক কার্যকর প্রক্রিয়া।
বক্তৃতার প্রাঞ্জলতা ও প্রভাব:
তাঁর বক্তৃতায় ছিল অসাধারণ প্রভাব। স্পষ্ট ভাষা, মিষ্টি উচ্চারণ ও যুক্তির দৃঢ়তা-এসব তাঁর বক্তৃতাকে শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলতে সহায়তা করত।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা:
তিনি ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতেন না। বরং, সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রয়োগ করে শিয়া অধিকার রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। আওধের নবাবদের সময় তিনি শিয়াদের ন্যায্য অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।
উপমহাদেশে শিয়াবাদ ও আজাদারির প্রসার
হযরত গুফরান মা'আব (র.) শুধুমাত্র শিয়া ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং আজাদারির সংস্কৃতিকেও শৃঙ্খলিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেন। তিনি মুহাররমের মজলিস ও মর্সিয়া পাঠকে একটি শিক্ষণীয় ও জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রমে পরিণত করেন। তাঁর চেষ্টায় লখনউ, নসীরাবাদ ও অন্যান্য শহরে শিয়া সম্প্রদায় সুসংগঠিত হয় এবং মানুষ যথার্থ শিয়া আকীদা সম্পর্কে অবগত হয়।
উপসংহার
হযরত গুফরান মা'আব (র.)-এর জ্ঞানভিত্তিক খিদমত, ইজতিহাদী প্রজ্ঞা ও দ্বীনি দায়িত্ববোধ শুধু উপমহাদেশে শিয়া মাযহাবের ভিত্তি মজবুত করেনি, বরং চিন্তাশীল ও অনুসন্ধানমুখী ধারার ভিত্তিও স্থাপন করেছে। আজও তাঁর জ্ঞান-ঐতিহ্য শিয়া আলেম, শিক্ষার্থী ও মুসলিম সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, জ্ঞান ও আমলের সমন্বয় এবং তাকওয়া ও ইজতিহাদের মূলনীতির অনুসরণই প্রকৃত দ্বীনি খিদমত।
লেখা: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট