হাওজা নিউজ এজেন্সি: সম্প্রতি ভারতে ওয়াক্বফ সম্পত্তি দখল, অপব্যবহার ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর রক্ষায় মুসলিম সংগঠনগুলির প্রতিবাদ ও আন্দোলন আলোচিত হচ্ছে। এই প্রতিবাদগুলির ধারা, পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সত্যিই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সম্পদ রক্ষার লড়াই, নাকি রাজনৈতিক ফায়দা ও গোষ্ঠীস্বার্থের খেলা?
ওয়াক্বফ রক্ষা: ঐশী দায়িত্ব বনাম জাতীয় দায়িত্ব
কুরআন ও হাদিসে সম্পদ রক্ষার নির্দেশনা থাকলেও, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মুসলিম সংগঠনগুলি রাষ্ট্রের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বৈততার মধ্যে পড়েছে। যেমন:
সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্ররক্ষার দৃষ্টান্ত: একটি দেশের সেনাবাহিনী যখন শত্রুর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়ে, তখনই সফল হয়। কিন্তু ওয়াক্বফ রক্ষায় মুসলিম গোষ্ঠীগুলি "বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ"-এর পথ বেছে নিয়েছে। ফলে দখলকারীরা আরও সাহস পেয়েছে।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা: ওয়াক্বফ বিল পাসের আগে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও, তা পর্যাপ্ত চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এটি "বালখিল্য" প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গণ্য হয়েছে।
মুসলিম সংগঠনগুলির ভূমিকা: একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা
১. পীরপন্থী গোষ্ঠী ও সমস্যা: এরা কুরআনের বদলে স্বনির্মিত "হাদিস" ও সুফি সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইকে তারা "অনৈতিক" মনে করে।
ফলাফল: ওয়াক্বফ রক্ষার চেয়ে মাজার ও খানকাহের প্রভাব বাড়ানোই এদের প্রাধান্য পায়।
২. আহলে হাদিস অন্তর্দ্বন্দ্ব: আকিদাগত বিতর্ক (যেমন "মানুষ নাকি পশুর মর্যাদা") নিয়ে বিভ্রান্তিতে এরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়তে ব্যর্থ।
*বাস্তবতা:* তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতার চেয়ে ব্যবহারিক সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ নগণ্য।
৩. তাবলীগ জামাত- প্রাধান্য: ইমান দৃঢ়তা ও ব্যক্তিগত পবিত্রতা (যেমন প্রস্রাবের পর পানি ব্যবহারের নিয়ম) তাদের মূল এজেন্ডা। সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামকে তারা "অপচয়" মনে করে।
সমালোচনা: "বাসন ধুয়ে পানি খাওয়া" স্তরের কাজে ব্যাস্ত থাকায় ওয়াক্বফ রক্ষার মতো বৃহত্তর ইস্যু উপেক্ষিত।
৪. জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ- রাষ্ট্রনীতি: ভারত সরকারের সমালোচনাকে "অরাজকতা" ও "পাকিস্তানি প্রভাব" হিসেবে দেখে। ফলে, ওয়াক্বফ ইস্যুতেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে অনমনীয় ভূমিকা নিতে অনিচ্ছুক।
প্যারাডক্স: উলামাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামে থাকলেও, বর্তমানে তারা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যকে "ইমানি দায়িত্ব" বলে প্রচার করে।
৫. শিয়া গোষ্ঠী (বোহরা সম্প্রদায়):
রাজনৈতিক মিত্রতা: কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষা। সুন্নিদের সংকটকে তারা সাম্প্রদায়িক প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে নেয়।
বিগ পিকচার: শিয়া-সুন্নি বিভাজন ওয়াক্বফ রক্ষার লড়াইকে দুর্বল করে।
৬. জামায়াতে ইসলামী হিন্দ:
কৌশলগত দুর্বলতা: কুরআনিক পদ্ধতিতে লড়াইয়ের ইচ্ছা থাকলেও, সরকারি দমন-পীড়নের ভয়ে তারা তাবলীগি কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ।
সংকট: "নিষ্প্রাণ" আন্দোলন দিয়ে মূল লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।
৭. উচ্চবিত্ত ও আধুনিক মুসলিম: বিচ্ছিন্নতা: ওয়াক্বফের প্রতি অনিহা; ইসলামকে তারা "কবর-ঈদের ধর্ম" হিসেবেই দেখে। সামাজিক প্রগতির নামে ধর্মীয় দায়বদ্ধতা ত্যাগ করেছে।
প্রতিবাদের রাজনীতি: লোকদেখানো নাকি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম?
মুসলিম সংগঠনগুলির বিক্ষোভের পেছনে দুটি উদ্দেশ্য প্রাধান্য পেয়েছে:
১. ভক্তদের ধরে রাখা: প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের অনুসারীদের মনোযোগ আকর্ষণে "প্রতিবাদ"কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।
২. বিধর্মী শক্তির ওপর নির্ভরতা: মুসলিমরা মনে করে, হিন্দু সংসদ সদস্য বা মানবাধিকার সংগঠনই তাদের পক্ষে কথা বলবে। কিন্তু বিধর্মীরা শুধু নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা অনুযায়ীই সমর্থন দেয়।
ফলাফল: আল্লাহর সৈনিকদের জন্য পুরস্কার নাকি শাস্তি?
কুরআন স্পষ্ট: "তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে" (সুরা বাকারা, ১৯৪)। কিন্তু মুসলিম গোষ্ঠীগুলি যদি:
- বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকে,
- ঐক্যবদ্ধ কুরআনিক কৌশল গড়তে ব্যর্থ হয়,
- রাজনৈতিক স্বার্থ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে আটকে থাকে,
তাহলে এটি আল্লাহর আইন লঙ্ঘন হিসেবেই গণ্য হবে। রাষ্ট্রও তাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ওয়াক্বফ দখল অব্যাহত রাখবে।
ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই একমাত্র পথ
পরিশেষে, ওয়াক্বফ রক্ষার লড়াই শুধু সম্পত্তির প্রশ্ন নয়; এটি মুসলিম সমাজের ঐক্য, বিশ্বাস ও নেতৃত্বের পরীক্ষা। কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী সংঘবদ্ধ, সুপরিকল্পিত ও নিষ্ঠুর প্রতিরোধ গড়ে তোলাই সময়ের দাবি। অন্যথায়, ইতিহাসের বিচারে আজকের মুসলিম নেতৃত্ব "আল্লাহর সৈনিক" নয়, বরং "নির্বাক দর্শক" হিসেবেই চিহ্নিত হবে—যাদের জন্য অপেক্ষা করছে ঐশী জবাবদিহি ও জাতীয় লজ্জা।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট