সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫ - ১৯:০৮
ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: স্বৈরাচার, উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের ত্রিভুজের বিরুদ্ধে

হাওজায়ে ইলমিয়া বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ধার্মিকদের আশ্রয়স্থল নয়, বরং সমগ্র জাতির আশ্রয়স্থল। চিন্তাবিদ, মুজাহিদ, সংস্কারক ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামরত ব্যক্তিত্বদের একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে, মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিরোধের ময়দানে একটি সভ্যতাগঠনকারী ভূমিকা পালন করেছে। আজ যদি “আধিপত্যবাদের পতন হোক” এই স্লোগান এখনও জীবন্ত থাকে, যদি উম্মাহর মধ্যে ন্যায়বিচারের ডাক প্রতিধ্বনিত হয়, তবে তার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র নিঃসন্দেহে এই ঐতিহ্যবাহী ও জনগণের প্রতিষ্ঠান।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম মূসা আগায়েরী কোমের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সিতে এক বিশেষ নিবন্ধে লিখেছেন: 

ইতিহাসের মানদণ্ডে মানুষের স্বাধীনতার চেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার আর কিছুই হয়নি। 

ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন রূপে সর্বদা মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। এই আধিপত্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হলে তা একটি ত্রিভুজ আকারে উপস্থাপন করতে হবে, যার তিনটি বাহু হলো: অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার, বৈদেশিক উপনিবেশবাদ ও বিশ্ব আধিপত্যবাদ।

এই ধ্বংসাত্মক ত্রয়ী বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে হাত মিলিয়ে জাতিসমূহের আত্মা ও সম্পদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু এই মহাসংঘাতের মাঝে ধর্মীয় সমাজের গভীর থেকে একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, যা কেবল এই অত্যাচারের দর্শকই নয়, বরং জাগরণের পতাকাবাহক হয়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র— একটি জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিপ্লবী দুর্গ, যা সর্বদা অত্যাচার ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়েছে। 

প্রথম বাহু: অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার—স্বাধীনতাকে দমন করে, ন্যায়বিচারকে অকার্যকর করে ও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে সকল প্রকার সংস্কার ও উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে। 

সাফাভী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র এই স্বৈরাচারের কাছে মাথা নত করেনি। মীরজা শিরাজী, আয়াতুল্লাহ নায়িনী, শেখ ফজলুল্লাহ নূরী ও ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মতো মহান আলেমদের সচেতনতামূলক কণ্ঠস্বর অন্ধকার স্বৈরাচারী শাসনামলে মানুষের হৃদয়ে আশা ও সচেতনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছে। 

দ্বিতীয় বাহু: বৈদেশিক উপনিবেশবাদ—উন্নয়ন ও সভ্যতার মুখোশ পরিধান করে মুসলিম সমাজগুলোকে চিন্তাগত, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পরাধীন করেছে। এই ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোই ছিল প্রথম প্রতিরোধকেন্দ্র। জিহাদের ফিকহ, গতিশীল ইজতিহাদ ও ধর্মীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনেক শিয়া আলেম শুধু উপনিবেশবাদকেই উন্মোচন করেননি, বরং জাতিকে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। মীরজা শিরাজীর তামাক বর্জনের ঐতিহাসিক ফতোয়া কেবল একটি ফিকহি সিদ্ধান্তই নয়, বরং উপনিবেশবাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে একজন মারজার প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ ছিল। 

তৃতীয় বাহু: বিশ্ব আধিপত্যবাদ—যা আমেরিকা, সায়োনবাদ ও বিশ্বব্যাপী আধিপত্যবাদী নেটওয়ার্কের রূপে নিজেকে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজও মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রের এই প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান সজাগ রয়েছে—প্রতিরোধ অক্ষের সমর্থন থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য-নির্ভর চিন্তাধারার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম পর্যন্ত। বিপ্লবী আলেম ও মাদ্রাসাভিত্তিক চিন্তাবিদদের কণ্ঠস্বর একদিকে প্রতিরোধ ফ্রন্টের প্রথম সারিতে ধ্বনিত হয়, অন্যদিকে ফিকহ, কালাম ও দর্শনের চেয়ারে আধুনিক সংশয়গুলোর জবাব দেয়। 

এই ভয়াবহ ত্রিভুজের বিপরীতে মাদ্রাসা কেবল ধার্মিকদের আশ্রয়ই নয়, বরং সমগ্র জাতির আশ্রয়স্থল। চিন্তাবিদ, মুজাহিদ, সংস্কারক ও ন্যায়বিচারকামী ব্যক্তিত্বদের একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিরোধের ময়দানে একটি সভ্যতাগঠনকারী ভূমিকা পালন করেছে। 

হাওজায়ে ইলমিয়া হলো নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর। এটি এমন একটি আয়না যা অত্যাচারকে প্রতিফলিত করে এবং এমন একটি আলো যা প্রতারণা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে আলো ছড়ায়। যদি মাদ্রাসাগুলো নিশ্চুপ হয়ে যায়, তবে জাতি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে, আর যদি মাদ্রাসাগুলো সজাগ থাকে, তবে কোনো অত্যাচারীই টিকে থাকতে পারবে না। 

আজ হাওজায়ে ইলমিয়ার দায়িত্ব কেবল ধর্ম রক্ষা নয়, বরং মানবতার সুরক্ষা। আর এর চেয়ে মহত্তর কোনো মিশন কি হতে পারে, যা মানুষকে এই অভিশপ্ত ত্রিভুজ থেকে মুক্তি দেবে?

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha