সোমবার ১৯ মে ২০২৫ - ০৯:০৩
স্মৃতিচারণ | তিনি রাজনীতির খেলোয়াড় নন, ছিলেন আদর্শিক রাজনীতির বিনির্মাতা

ইমাম রেজার শহর মাশহাদের সরু গলি থেকে শুরু করে তেহরানের পাস্তুর পর্যন্ত, জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি ছিলেন অবিচল ও দৃঢ়। তরুণ বিচারকের রূপে তার ন্যায়ের কলম সমাজের কলুষতা মুছে দিত। তখনও হয়তো জানতেন না, একদিন ইতিহাস তার হৃদস্পন্দন শুনবে—তবুও সেই হৃদয় কেবল দুঃখী, নিপীড়িত মানুষের জন্যই ধুকত।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:  শহীদ রায়িসি, রাজনীতির খেলোয়াড় ছিলেন না— ছিলেন রাজনীতির বিনির্মাতা; এমন এক রাজনীতি, যার মধ্যে ছিল না ক্ষমতার মোহ, ছিল না রাজ-সিংহাসনের লোভ; বরং ছিল নিপীড়ন ও বৈষম্যের মূল উপড়ে ফেলার এক অনমনীয় সংকল্প।

আজ যার কথা বলছি, তিনি সেই “শহীদ-এ খিদমত”—যিনি হঠাৎ করেই উড়াল দিলেন অনন্তের পথে; যেমনটা সবসময় নীরব পদক্ষেপে চলতেন, তেমনি নিঃশব্দেই পাড়ি জমালেন আকাশের ওপারে।
শহীদ সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি কেবল একটি নাম নন—তিনি এক গল্প; মাটির মতো বিনম্র হাসি থেকে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো এক অনন্য অধ্যায়।

তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ, যার জামায় থাকত নিপীড়নের ঘ্রাণ, যার হাত প্রসারিত ছিল নিঃস্বদের প্রতি অকৃপণ সহানুভূতিতে। তিনি ছিলেন সেই মুখচ্ছবি, যাকে আজ আমরা বলি: “নির্মোহ খিদমত।”

তার জীবনযাপন ছিল এক অপূর্ণ কবিতা—প্রত্যেকটি চরণে লুকিয়ে ছিল ভোগবাদীদের জন্য এক সুক্ষ্ম হাহাকার। রাষ্ট্রপতির প্রাসাদেও তিনি জীবন কাটাতেন মাদ্রাসার কক্ষে যেমন থাকতেন তেমনি করে। প্রাচীরের গায়ে ইট হোক কিংবা মার্বেল—তা তাঁর কাছে তুচ্ছ; কারণ সত্যিকার দীপ্তি ছিল তাঁর নির্মল আত্মায়। তার আহার ছিল সামান্য, কিন্তু তার দান ছিল সীমাহীন।

আর ন্যায়বিচার... তা যেন প্রবাহিত হতো তার ধমনীতে। বিচারকের আসনে হোন কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়—তিনি কখনো ন্যায়বিচার খুঁজতেন না কেবল সংবিধানে, বরং খুঁজতেন মানুষের কষ্টময় নিঃশ্বাসে। তাঁর কাছে ন্যায়বিচার ছিল এক ধরনের ইবাদত—নির্ভেজাল, নির্মোহ, আত্মিক সাধনা।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর, পদ নয় বরং দায়িত্বকে দেখেছিলেন আশীর্বাদরূপে—তৃষ্ণার্ত মাটির জন্য এক শান্তির বারিধারা। তার দৃষ্টিতে সদা ভেসে বেড়াত এক প্রশ্ন: “আমি নিপীড়িতদের জন্য কী করেছি?”
জনজীবনের সংকট ছিল তাঁর আত্মার যন্ত্রণা; তিনি এর সমাধানে নিরন্তর ছুটে বেড়াতেন। কঠিন নিষেধাজ্ঞাও তাকে দুর্বল করতে পারেনি; তিনি ছিলেন ইরানের পর্বতের মতো—অটল, অচঞ্চল।

একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত—জাতিসংঘের মঞ্চে রায়িসির কণ্ঠে ইরানের আত্মা

রাষ্ট্রপতির আসনে থেকেও, জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি সেই স্থানে রচনা করলেন ভালোবাসা ও প্রতিরোধের এক নতুন ইতিহাস। যখন তিনি হৃদয়ের শ্রদ্ধায় তুলে ধরলেন সর্দার-এ-দিলহা, হাজ কাসেম সোলায়মানির ছবি, তখন তা যেন প্রতিটি শহীদের রক্তের প্রতিফলন হয়ে উঠল। তা কাঁপিয়ে দিলো চতুর রাজনীতিকদের, যারা কখনও এমন নিখাদ ভালোবাসা ও জাতির একাত্মতা দেখেনি।

এরপর তিনি যখন কুরআন শরীফ হাতে তুলে ধরলেন—তখন মনে হলো তিনি বলছেন, “শহীদরা কুরআনেরই সন্তান এবং তারা কুরআনের দিকেই ফিরে যায়।”

অতঃপর... সেই ঘন কুয়াশা, সেই ভাগ্যঘন মুহূর্ত

যখন হেলিকপ্টারটি নিখোঁজ হওয়ার খবর এলো, সারা দেশের বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অজানা এক আতঙ্ক। অথচ, আমাদের প্রিয় ও দূরদর্শী নেতা সেই ভয়াল সময়েও ছিলেন অটল ও সাহসের প্রতীক। তাঁর গভীর দৃষ্টি, যা যুগে যুগে জাতির আশ্রয় হয়ে থেকেছে, এবারও শান্তির আলোকরেখা হয়ে উঠল। তাঁর মুখাবয়ব—যেন বিপ্লবের সংগ্রামী ইতিহাসের মানচিত্র—এই শোকেও হয়ে উঠল সহনশীলতা ও নেতৃত্বের প্রতীক।

আর তখন... শাহাদাত

রায়িসির এই আকস্মিক বিদায় যেন পূর্ণতা দিল সেই অধ্যায়কে, যা এখনো অপূর্ণ ছিল। যিনি সবসময় নিঃশব্দে বেঁচে ছিলেন, তিনিই এবার চিরনিদ্রায় নিঃশব্দে শায়িত হলেন। কিন্তু তাঁর রক্ত হয়ে উঠল এক উচ্চকণ্ঠ বার্তা: “শহীদদের পথ শেষ হয় না; তা চিরন্তন এক যাত্রা।”

আজ তিনি হলেন “সাইয়্যেদুশ্‌:শুহদায়ে খিদমত”—শুধু এই কারণে নয় যে তিনি কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন, বরং এজন্য যে তিনি তাঁর পুরো জীবনকেই বানিয়ে তুলেছিলেন এক সেবাপূর্ণ মহাকাব্য।

তাঁর স্মৃতি আজ কেবল সমাধী ফলকে নয়, বরং প্রতিটি এমন মানুষের পদচিহ্নে জীবন্ত, যারা প্রতিদিন নতুন আশায় জেগে ওঠে—এই গর্বিত ইরান ইসলামির পতাকাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরার প্রত্যয়ে।

রায়িসি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর ন্যায়বিচারের পাখি আজও উড়ছে ইরানের আকাশজুড়ে।

লিখেছেন- মাজিদ লাহিজানি

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha