সোমবার ১৯ মে ২০২৫ - ১৬:৪৮
“নেক কাজের আদেশ” — একটি সভ্যতামূলক ও সামাজিক দায়িত্ব;

“নেক কাজের আদেশ” — একটি সভ্যতামূলক ও সামাজিক দায়িত্ব;

হাওযাভিত্তিক জ্ঞানচর্চায় এর পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা

ইরানে "নেক কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার" গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান, হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলিমিন মুসাভী মোকাদ্দাম, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও হাওযা তথা ধর্মীয় বিদ্যাপীঠগুলোর জ্ঞানতাত্ত্বিক, ফিকহি ও সামাজিক ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করে বলেন—এই ইসলামী নির্দেশনা পুনর্বিবেচনা ও একটি সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, নেক কাজের আদেশ: হাওযাভিত্তিক বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক অবস্থান
তিনি বলেন, গত শতাব্দীতে শিয়া ফিকহ প্রচার ও শিক্ষা প্রদানে হাওযাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা “নেক কাজে আদেশ” ও “মন্দ কাজে নিষেধ” সম্পর্কে বিভিন্ন পন্থায় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে। যদিও ফিকহি দিক থেকে এর বাধ্যতামূলকতা সর্বসম্মত, এর বাস্তব প্রয়োগ সামাজিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।

ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান
ইসলামী বিপ্লবের পর এই দায়িত্ব বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তবে এখনও এর গঠনমূলক বাস্তবায়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং একটি সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ: ফিকহ, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান গঠন

১. ফিকহ: ব্যক্তিগত দায়িত্ব থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

মুসাভী মোকাদ্দাম বলেন, ইসলামে এটি একটি নির্ধারিত ফরজ আমল, যেটি বিভিন্ন শর্ত যেমন প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা, ক্ষতির আশঙ্কা না থাকা, এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে কার্যকর হয়। তিনি বলেন, ইমাম খোমেইনী ও আয়াতুল্লাহ নাইনীর মতো আলেমগণ এটিকে শুধুই ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২. সমাজ: নৈতিকতা থেকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ

ইতিহাসগতভাবে, কাজার আমলে এটি শুধু ব্যক্তিগত নসিহত পর্যায়ে ছিল। তবে রেজা খানের ‘বেপর্দা’ নীতির বিরোধিতার সময়, এটি রাজনৈতিক প্রতিবাদে রূপ নেয়। ইসলামী বিপ্লবের পর, এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে আসে।

৩. সভ্যতা: প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও নতুন গঠনমূলক কথোপকথনের প্রয়োজন

আজকের জটিল সমাজে কার্যকর ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। মুসাভী মোকাদ্দাম বলেন, এটি এখনও হাওযাভিত্তিক গঠনে একটি স্থায়ী ও সংহত গফতগু (গভীর আলোচনা)-তে পরিণত হয়নি; বরং অনেক সময় বিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়িত হয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি: মশরুতাহ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র

মশরুতাহ বিপ্লবের সময় এ দায়িত্ব নৈতিক পর্যায়ে থাকলেও, সামাজিক আন্দোলনের সময় এটি রাজনৈতিক রূপ নেয়। আয়াতুল্লাহ নাইনীর মতো আলেমরা এটিকে স্বৈরাচারবিরোধী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
পাহলভি যুগে এটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের রূপ নেয় এবং ইসলামী বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর সামাজিক প্রভাব মাঝে মাঝে দুর্বল হয়ে গেছে, এবং নেতিবাচক পন্থা ইতিবাচক পন্থাকে ছাপিয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গঠনমূলক পুনঃব্যাখ্যা: নৈতিকতা ও সামাজিক জীবনে একটি সভ্যতামূলক মানদণ্ড

তিনি বলেন, এটি শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয় বরং একটি সভ্যতা নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সামাজিক নৈতিকতা রক্ষা, নাগরিক জীবন পরিচালনা এবং নৈতিক সংকট মোকাবেলায় এটি কৌশলগত ভূমিকা পালন করতে পারে।

তিনটি মূল পরিবর্তন দরকার গফতগু পুনর্গঠনের জন্য

১. জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তন

ধর্মীয় উৎসসমূহকে সভ্যতাভিত্তিক পদ্ধতিতে পুনর্পাঠ, সামাজিক ফিকহের বিকাশ এবং প্রযুক্তি ও অনলাইন নৈতিকতার মতো নতুন বিষয়েও ইজতিহাদ প্রয়োজন।

২. কাঠামোগত পরিবর্তন

রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান থেকে জনগণভিত্তিক ও বিশেষায়িত নেটওয়ার্ক গঠনের আহ্বান জানান। শিক্ষা, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও মানবাধিকার কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেও এই দায়িত্ব ফলপ্রসূভাবে পালন করা যেতে পারে।

তিনি পাড়া-মহল্লাভিত্তিক "সামাজিক নৈতিকতার ঘর" প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথাও বলেন, যা স্থানীয় কথোপকথনা ও সম্মিলিত উদ্যোগের কেন্দ্র হবে।

৩. পদ্ধতিগত পরিবর্তন

তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী হুঁশিয়ারি বা বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে আজকের দুনিয়ায় আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ, শিল্প ও গণমাধ্যমের ব্যবহার দরকার। শাস্তির বদলে সামাজিক উৎসাহ প্রদানের দিকে গুরুত্বারোপ করেন।

উপসংহার: ব্যক্তিকরণ নয়, সামাজিকীকরণ প্রয়োজন

এই ফরজ দায়িত্বকে শুধু ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ না রেখে, এটিকে সামাজিক ও সভ্যতাভিত্তিক প্রকল্পে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বর্তমান সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে নতুন কৌশল গ্রহণ করাই হবে সফলতার চাবিকাঠি।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha