মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ - ২০:৫০
ইরানের প্রতিরোধ মধ্যপ্রাচ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে: আরব বিশ্লেষক

বিশিষ্ট আরব রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক আব্দুল বারি আতওয়ান সম্প্রতি ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, “তেহরান— তেলআবিব ও ওয়াশিংটনকে একটি বড় শিক্ষা দিয়েছে ।” তিনি ইরানি জনগণের ঐক্য, প্রতিরোধ এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থনকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আব্দুল বারি আতওয়ান ১২ দিনের এ যুদ্ধকে ইরান ও অঞ্চলের সমসাময়িক ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার মতে, এ যুদ্ধ কেবল ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রকাশ নয়, বরং জাতীয় ঐক্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলের ভুল অনুমান কেন ব্যর্থ হলো?
মেহর নিউজের প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে আতওয়ান বলেন, “ইসরায়েল মনে করেছিল, ১৩ জুন ভোরে আকস্মিক হামলা চালিয়ে এবং ইরানের সামরিক ও নিরাপত্তা কমান্ডারদের শহীদ করে তেহরানে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি করা যাবে। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর তাৎক্ষণিক নেতৃত্বে নতুন কমান্ডার নিয়োগের মাধ্যমে ইরান দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই প্রস্তুতি ও গতিশীলতা ইসরায়েলকে স্তব্ধ করে দেয়। তারা অভ্যস্ত ছিল শক-নীতি ও গুপ্তহত্যা চালাতে, কিন্তু এবার ইরান অপ্রত্যাশিত গতিতে পাল্টা জবাব দেয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাত হানে, যা ইসরায়েলের কল্পনারও বাইরে ছিল।”

ইরানিদের ঐক্যের রহস্য কী?
জবাবে আতওয়ান বলেন, “ইরানি জাতি কখনোই দখলদার ও আগ্রাসী ইসরায়েলের পক্ষ নিতে পারে না। তারা আমেরিকা, ইসরায়েল এবং নেতানিয়াহুকে বিস্মিত করেছে। তারা দেখিয়েছে—যদিও কোনো রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, তারা কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তারা সবসময় নিজেদের নেতার ও বিপ্লবের পাশে থাকে। আমি এই মহান জাতিকে সালাম জানাই, যারা বিভেদ পেছনে ফেলে রাষ্ট্র ও নেতৃত্বের পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। এই চিত্র আমেরিকা ও ইসরায়েলকে হতবাক করেছে।”

এই যুদ্ধে জয়ী কে, পরাজিত কে?
এ প্রশ্নের জবাবে আতওয়ান বলেন, “এখানে কোনো সন্দেহ নেই—ইরান বিজয়ী হয়েছে। তারা লড়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য আমেরিকার সঙ্গে এবং পাশাপাশি পশ্চিমা সমর্থিত ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইসরায়েল কিছুই অর্জন করতে পারেনি—এটাই পরাজয়। ইরান আঘাত হেনেছে, অবস্থান ধরে রেখেছে এবং আঞ্চলিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। এটি আমেরিকা ও ইসরায়েলের জন্য এক প্রবল ধাক্কা।”

যুদ্ধবিরতির পর নতুন হামলার সম্ভাবনা?
আতওয়ান বলেন, “পরিস্থিতি পরিষ্কার—ইসরায়েল পরাজিত এবং নেতানিয়াহু বিপর্যস্ত। তিনি যুদ্ধের শুরুতে 'ঐতিহাসিক বিজয়' দাবি করেছিলেন, কিন্তু এরপর সেই দাবির পুনরাবৃত্তি করেননি। ফিলিস্তিনি সূত্রে আমি জেনেছি, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবের কেন্দ্রে বহুতল ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। সরকারি ও সামরিক স্থাপনাগুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।”

তিনি যোগ করেন, “এখন ইসরায়েলিরা নেতানিয়াহুর জবাবদিহি চাইছে। তারা বলছে, ‘এই যদি বিজয় হয়, তাহলে আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস, সম্মানহানি আর ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?’”

ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট কি গোটা অঞ্চল?
আতওয়ানের মন্তব্য: “গাজা, লেবানন, সিরিয়া ও ইরানের পর ইসরায়েল অন্যান্য ইসলামি দেশেও হামলার পরিকল্পনা করছে—এমন আশঙ্কা থাকলেও ইরানের প্রতিরোধ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইরান একা দাঁড়িয়েছে, কারও সহায়তা চায়নি—না রাশিয়ার, না অন্য কারও। এটাই এই জাতির মর্যাদা। ইরানের দৃঢ়তা পুরো আরব অঞ্চলকে সুরক্ষা দিয়েছে।”

উপসংহার: আব্দুল বারি আতওয়ানের বিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে—ইরানের প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব, জনগণের ঐক্য ও প্রতিরোধশক্তি কেবল নিজেদের রক্ষা করেনি, বরং গোটা অঞ্চলের জন্য এক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে। এই বিজয় রাজনৈতিক, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক চরম ধাক্কা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন বাস্তবতার সূচনা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha