হাওজা নিউজ এজেন্সি: সেদিনের কুফার রোদে যখন ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন এক কোমল শিশু, তখন হাবীব ছিলেন এক উদীয়মান তরুণ। তাঁর বয়স তখন প্রায় বিশ বছর। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে বাসা বেঁধেছিল এক গভীর ও পবিত্র প্রেম—যা কেবল হুসাইন (আ.)-এর দিকেই ধাবিত হতো। হাবীবের চোখে ছিল একটিই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য—ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র চেহারা।
এই প্রেম ছিল এমন, যা হাবীবকে নিজেকে ভুলিয়ে দিত। তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি ভালোবাসাকে শুধু অনুভব করতেন না, বরং তা নিজ জীবনে পূর্ণতা দিতেন আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে।
একদিন তাঁর পিতা মাজাহের বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, পুত্র, কী এমন হয়েছে যে তুমি এক মুহূর্তও হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে দূরে থাকতে পারো না?
হাবীব মাথা নিচু করে বিনয়ী কণ্ঠে বললেন,
— বাবা, এ প্রেম আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না। কেবল জানি, হুসাইন (আ.)-কে ভালোবাসি। এমন ভালোবাসা যা আমাকে ফানা করে দেয়, তাঁর প্রেমে আমি আমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলি।
পিতা মুগ্ধ হয়ে বললেন,
— বল হাবীব, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছা কী?
হাবীব হেসে বলল,
— যদি হুসাইন (আ.) আমাদের ঘরে অতিথি হন, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।
এই পবিত্র স্বপ্ন পূরণে পিতা হাজির হলেন হযরত আলী (আ.)-এর দরবারে। বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলেন,
— ইয়া আমিরুল মুমিনিন, একদিন আপনার সন্তানদের নিয়ে আমাদের ঘরে পা রাখুন।
হযরত আলী (আ.) সস্নেহে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। দিন নির্ধারিত হলো।
প্রতীক্ষিত সেই দিন ঘনিয়ে এলো। হাবীবের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ উঠল। তিনি ছাদে উঠে অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রিয় অতিথিদের আগমনের আশায়। দূর থেকে ধুলো উড়ে এলো, দেখা গেল—হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) আসছেন।
হাবীবের হৃদয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যাকুলতায় ছাদ থেকে নামার সময় তাঁর পা পিছলে যায়। মাটিতে পড়ে তিনি প্রাণ হারান।
মাজাহের ছুটে এসে দেখলেন—প্রাণপ্রিয় পুত্র নিথর হয়ে পড়ে আছে। বুক ফেটে গেল তাঁর। কিন্তু ইমামদের সামনে শোকপ্রকাশ না করে পুত্রের দেহ ঘরের এক কোণে সরিয়ে রাখলেন।
ইমাম আলী (আ.) ঘরে প্রবেশ করে বললেন,
— হাবীব কোথায়? আমি যার হৃদয়ে হুসাইনের জন্য এমন প্রেম দেখেছি, সে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এলো না কেন?
মাজাহের কষ্ট চেপে বললেন,
— ইয়া মাওলা, সে এক কাজে ব্যস্ত।
কিন্তু ইমামের হৃদয় বুঝে গেল কিছু ঘটেছে। পুনরায় জিজ্ঞেস করলে মাজাহের সব ঘটনা খুলে বললেন।
ইমাম আলী (আ.)-এর চোখ অশ্রুসজল হলো। তিনি বললেন,
— হাবীবের দেহ নিয়ে এসো।
যখন পবিত্র ইমাম হাবীবের নিথর দেহ দেখলেন, তিনি কেঁদে উঠলেন। হুসাইন (আ.)-এর দিকে ফিরে বললেন,
— পুত্র, দেখো! তোমার প্রেমে এক তরুণ নিজের জীবন উৎসর্গ করল। তুমি তার ভালোবাসার কী প্রতিদান দেবে?
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল। তিনি দুই হাত তুলে দোয়া করলেন,
— হে আল্লাহ! এই পবিত্র প্রেমের মর্যাদা দাও। হাবীবকে প্রাণ ফিরিয়ে দাও।
আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন। হাবীব আবার জীবিত হলেন।
ইমাম আলী (আ.) স্নেহভরে বললেন,
— হাবীব, হুসাইনের প্রতি তোমার নিঃস্বার্থ প্রেমের কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত যারা হুসাইন (আ.)-এর জিয়ারত করবে, তুমি তাদের তালিকায় তাদের নাম লিখে রাখবে।
এই কারণেই আমরা জিয়ারতের সময় বলি:
السلام علی حبیب بن مظاهر الاسدی، الذی أحیاه الله مرتین و أماته مرتین
সালাম হোক হাবীব ইবনে মাজাহের (আ.)-এর প্রতি, যিনি দুইবার জীবিত হয়েছিলেন এবং দুইবার মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কারবালার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বীর
এই সেই হাবীব, যিনি কারবালার প্রান্তরে ষাট বছর বয়সে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেন। তাঁর কণ্ঠে শেষ কথা ছিল:
—আমি হুসাইনের জন্য জীবন দিয়েছি, এটাই আমার প্রেমের প্রমাণ।
তাঁর জীবন ছিল প্রেম, মৃত্যু ছিল প্রেম, এবং পুনর্জন্মও ছিল প্রেমেরই মর্যাদা।
[সংকলিত ও পরিমার্জিত]
আপনার কমেন্ট