সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ - ২১:৩৫
আমেরিকা ও ইসরায়েল কেন যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হলো? সামনে কী—আহযাব, হুনায়ন না কি ওহুদ?

ইরানের বিশিষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মাহদি মাশকেবাফ বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার বাস্তব কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা এমন এক সংবেদনশীল সময়ে অবস্থান করছি, যা সংকেত দিচ্ছে যে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হতে পারে। যদি আমরা প্রস্তুত না থাকি, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবো, আর প্রস্তুত থাকলে বিজয় আমাদের হবেই।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: মাহদি মাশকেবাফ বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আমরা কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতিকে গ্রহণ করি—আমরা কি 'ওহুদের' মতো পরাজিত হব, না কি 'আহযাব' ও 'হুনায়নের' মতো ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করব?

আমেরিকার পরাজয় ও যুদ্ধবিরতির পেছনের বাস্তবতা
মাশকেবাফ বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর আমেরিকা দুইবার ইরানে হামলা করেছে—একবার ছিল ‘ঈগলের পাঞ্জা’ অপারেশন যা তাবাস মরুভূমিতে ব্যর্থ হয় এবং দ্বিতীয়বার ফোর্দোতে। উভয় ক্ষেত্রেই আমেরিকা পরাজিত হয়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়।

ইসরায়েলও একই পথ অনুসরণ করেছে। মাশকেবাফ জানান, ইরান ইসরায়েলের আগ্রাসনকে পূর্বাভাস দিয়ে মাঠে সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল, ফলে যুদ্ধটি একরকম ইরানের কৌশলে চলে আসে। ইরান এমনভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে যে তা চলছিল আন্তর্জাতিক আলোচনার মাঝখানে, যাতে গোটা বিশ্ব দেখতে পায় ইরান শান্তির পক্ষপাতী, কিন্তু শক্তির দিক থেকেও নির্ভীক।

যুদ্ধবিরতির তিনটি মূল কারণ
তিনি বলেন, ইসরায়েল তিনটি কারণে যুদ্ধবিরতির আবেদন করতে বাধ্য হয়:

১. ব্র্যান্ড-ডাউন ব্যর্থতা: ইসরায়েল চেয়েছিল ইরানি সরকার পতন করাতে, কিন্তু উল্টো ইরানে জাতীয় সংহতি ও সামাজিক ঐক্য আরও সুদৃঢ় হয়।

২. ইরানের অপ্রত্যাশিত আক্রমণ কৌশল: ইরানের সামরিক আক্রমণ ছিল সময়, স্থান এবং অস্ত্রের ধরনে এতটাই পরিবর্তনশীল ও অপ্রত্যাশিত যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।

৩. আল-উদেইদ ঘাঁটিতে হামলা: ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি আল-উদেইদে আঘাত হানে—এটি বার্তা দেয় যে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো সামরিক ঘাঁটি নিরাপদ নয়, এমনকি কৌশলগত মিত্ররাও নয়।

সাম্প্রতিক যুদ্ধ থেকে নেওয়া শিক্ষা
তিনি বলেন, এই যুদ্ধ দেখিয়েছে, যারা মনে করত যুদ্ধে শুধু সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা ভুল। কারণ শহীদদের মধ্যে কর্মকর্তারাও ছিলেন। এ ছাড়া, ইরান নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা, ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি এবং কৌশলগত নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি শক্ত বার্তা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের সময় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সরাসরি অপারেশন রুমে উপস্থিত ছিলেন এবং কৌশলগত সিদ্ধান্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটি বিজয়ের মূল উপাদান ছিল।

আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
তিনি সতর্ক করেন, যদিও ইরান যুদ্ধে জিতেছে, তবু দেশটি অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক বিভাজন, সামাজিক টানাপড়েন, নিরাপত্তাগত দুর্বলতা ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এসব দুর্বলতা থেকেই শত্রুরা আক্রমণের সুযোগ খুঁজে পেয়েছিল।

সামনের করণীয়

১. 'রেওয়ায়াতে ফাতহ' চালু করা: জনগণের বিজয় ও নেতার ভূমিকা দৃশ্যমান করতে হবে।

২. সামাজিক সহনশীলতা বাড়ানো: জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। যেমন, হযরত আলী (আ.) বলেছেন: "আক্রমণের মধ্যে কিছু বিরতি হতাশার নয়, বরং নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়"।

৩. আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বাস পুনর্গঠন: জনগণকে বোঝাতে হবে পারমাণবিক কর্মসূচি অর্থহীন নয়—এর বহু ইতিবাচক প্রয়োগ রয়েছে যেমন ঔষধ উৎপাদন।

প্রতিরোধের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা
তিনি বলেন, এখনই সময়, সারা দেশে মসজিদভিত্তিক প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে তোলা। যেমন ১৯৮০-এর দশকে দেখা গেছে। এই সংগঠনগুলোকে তাওহিদি চেতনা, আত্মত্যাগ ও ঈমানি শক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত করতে হবে।

পরিসমাপ্তি: হুজ্জাতুল ইসলাম মাশকেবাফ বলেন, “ইসরায়েলের পতন শুধু সামরিক হামলায় নয়, বরং তার ভেতর থেকে ভাঙনের মাধ্যমেই হবে। তবে কখনো কখনো সেই পতনকে ত্বরান্বিত করতে সামরিক হামলার প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ঐক্য ও প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রতিরোধ ও বিজয়ের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha