মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫ - ২০:৪৪
মিশরের ইরান ও চীনের প্রতি ঝোঁক: কৌশলগত পদক্ষেপ, না তাৎক্ষণিক প্রয়াস?

বিশিষ্ট আরব বিশ্লেষক আবদুল বারি আতওয়ান মনে করেন, উপসাগরীয় মিত্রদের কাছ থেকে উপেক্ষিত হয়ে পড়া মিশর এখন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে নিজের অবস্থান পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে ইরান ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। তার এই ঝোঁক তাৎক্ষণিক নয়, বরং এটি একটি সুদূরপ্রসারী কৌশলগত রূপরেখার অংশ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: “রাই আল-ইয়াওম” পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এবং আরব বিশ্বের খ্যাতিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুলবারি আতওয়ান সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে মিশরের নীতি পরিবর্তনের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলেন, মিশর বর্তমানে আরব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূলধারা থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েছে। ফলে দেশটির সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার একটি ব্যাপক আত্মমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং জাতীয় ভূরাজনৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে।

একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে আতওয়ান বলেন, মিশর এখন দুটি বড় পরিবর্তনের পথে হাঁটছে—ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করা।

আতওয়ান মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাত সফর এবং তাতে মিশরকে উপেক্ষা করা—এটি কায়রোর জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। বিশেষ করে যখন সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমদ আশ-শারাআ-কে সৌদি আরবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেটা মিশরের নেতৃত্বকে গভীরভাবে আহত করে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে আসার পরামর্শ
আতওয়ানের মতে, মিশরকে উচিত যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর ঘাঁটি—যার শুরু ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর থেকেই—তা থেকে বেরিয়ে আসা এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরান ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা।

তিনি বলেন, “উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই এখন ইসরায়েলকে মিশরের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে। ফলে মিশরের প্রতি তাদের কৌশলগত গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে।”

তিনি উল্লেখ করেন, সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাত ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের উপঢৌকন দিলেও মিশরের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা ঋণ পরিশোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ, এসব দেশের একটি সিরিয়ার সরকারের পতনের জন্য মিশরের ঋণের দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করেছে।

ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের সঙ্গে টানাপোড়েন
আতওয়ান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ‘গাজাবাসীদের বাস্তুচ্যুতি প্রকল্পে’ অংশ না নেওয়ায় এবং ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে কায়রোর সম্পর্ক শীতল হয়ে গেছে। একইভাবে মিশর ইয়েমেন যুদ্ধেও অংশ নেয়নি, যা ওয়াশিংটনের অসন্তুষ্টির আরেক কারণ।

তিনি বলেন, “মিশরের এই নীতিগত অবস্থান কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং ইসরায়েলকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে।”

ইরানের দিকে ঝোঁক: রাজনৈতিক ও সামরিক সুবিধা
আতওয়ান বলেন, ইরানের সাম্প্রতিক সাফল্য—বিশেষ করে আমেরিকা-ইসরায়েলের হামলার মুখে পরমাণু কেন্দ্র রক্ষা এবং উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তি অর্জন—মিশরের জন্য সম্ভাবনাময় এক অংশীদারিত্বের দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

“ইরান এখন এমন এক শক্তি, যার কাছ থেকে মিশর প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সহায়তা পেতে পারে। তাদের প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ করে দিয়েছে।”

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক: ডলার নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপ
আতওয়ান আরও বলেন, চীন এখন এক বিকল্প অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা পশ্চিমা কিংবা ইহুদি প্রভাবের বাইরে। মিশর চীনের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে, যা পাকিস্তান-ভারত সংঘাতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

সম্প্রতি মিশর ও চীনের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছে, তা ডলার ও পশ্চিমা অর্থব্যবস্থাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা
আতওয়ান সতর্ক করেন, ইসরায়েল রাফাহ সীমান্তে গাজার বাসিন্দাদের ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের সিনাইয়ে স্থানান্তরের মাধ্যমে মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিতে পরিণত হতে পারে। এ ছাড়া সিরিয়া ও লেবাননের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য বিভক্তিও মিশরের জন্য উদ্বেগের কারণ।

উপসংহারে আতওয়ান বলেন, “মিশরকে এখন ঘুম থেকে জেগে উঠে তার ঐতিহাসিক ও কৌশলগত ভূমিকা ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্যাম্প ডেভিড-পরবর্তী যুগের সব ভুল সংশোধন করতে হবে। আরব ও ইসলামি ইস্যু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীতি তাকে দুর্বলতা ও অপমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

তিনি মিশরের প্রতি পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, “মিশর যেন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সহায়তা’ গ্রহণ করে আরও নিয়ন্ত্রণে না পড়ে। কারণ এই সহায়তা আসলে একপ্রকার চাপের কৌশল—নির্ভরতা নয়।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha