সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫ - ১৬:৪০
ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর দৃষ্টিতে মানবাধিকার বনাম পাশ্চাত্য মানবাধিকার

মানবাধিকারের বিষয়ে আমাদের ও পশ্চিমাদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্যটি নিহিত রয়েছে মানুষের পরিচিতি ও তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায়। পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ মূলত একটি বস্তুগত সত্তা—অর্থাৎ কেবল ভোগ ও ইন্দ্রিয়তাবাদে সীমাবদ্ধ। এরই পরিণতিতে তারা একটি এমন “সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ” তৈরি করেছে, যেখানে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। ওই সনদে মানুষের কেবল ভোগবাদী ও প্রাণিসুলভ দিকগুলোই গুরুত্ব পেয়েছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: তাহিরা মোওহেদীপুরের লেখায় উঠে আসা চিত্র তুলে ধরছি:

একটি বাস্তব চিত্র
রংচটা একটি ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইমাম চারপাশে তাকিয়ে দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ইমামের এক চাচাতো ভাই। আমাদের দেখে তাঁর ক্লান্ত মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। ইমাম তাঁর সঙ্গে করমর্দন করে হাতে গুঁজে দিলেন কিছু দীনার। আমি আমার বহন করা আটা ভর্তি থলেটা তাঁর হাতে দিলাম।

তিনি একটু অভিমান নিয়ে বললেন— আজ একটু দেরি করে এলেন, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। তবুও ধন্যবাদ, হে সদ্ব্যক্তি! আপনি তো আমাদের অচেনা, তবুও সাহায্য করছেন। অথচ আমার নিজের চাচাতো ভাই আলী ইবনে হুসাইন—যে নিজেকে ইমাম বলে দাবি করে—সে তো আমাদের খোঁজ নেয় না! খোদা যেন তাকে ভালো না রাখে!

এই কথা শুনে আমার রাগে গা কাঁপে, দাঁত কচকচ করে উঠে। বুঝতে পারি ইমাম আমার অনুভূতি টের পেয়েছেন, তাই ধীরে ধীরে আমার হাত চেপে ধরেন—যেন বলতে চান, কিছু বলো না।

ওই ব্যক্তি আবার ইমামকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। অন্ধকার গলিতে আমরা হাঁটতে থাকি। আমার মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—ইমাম কেন এমন স্বার্থপর আর কৃতঘ্ন লোককে সাহায্য করেন?

ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন,
“আমার পিতা (ইমাম সাজ্জাদ) রাতের অন্ধকারে নিজের পিঠে এক থলে তুলে নিতেন, যা দীনার, দিরহাম ও খাদ্যে ভরা থাকত। তিনি গোপনে দরিদ্রদের ঘরে গিয়ে এসব দিয়ে আসতেন, এমনকি মুখ ঢেকে রাখতেন, যেন কেউ চিনতে না পারে। তাঁর ইন্তেকালের পর দরিদ্ররাই বুঝতে পারে—সে রাতের সেই রহস্যময় সাহায্যকারী ছিলেন আলী ইবনে হুসাইন (আ.)।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪৬, পৃষ্ঠা ৬২]

একটি বিস্তৃত ও মূল্যবোধভিত্তিক মানবাধিকার
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কেবল মানুষের বস্তুগত অধিকার নিয়ে ভাবেননি; তিনি মানুষের আত্মমর্যাদা, সম্মান ও আধ্যাত্মিক অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

এই ইমামের পক্ষ থেকে এক অনন্য গ্রন্থ আমাদের হাতে এসেছে, যা পরিচিত “রিসালায়ে হুকূক” বা মানবাধিকারের পাণ্ডুলিপি নামে।

এই পাণ্ডুলিপিতে মানুষকে একটি সম্পূর্ণ সত্তা হিসেবে দেখা হয়েছে—শুধু ভোগের যন্ত্র নয়, বরং ইহকাল ও পরকালের যোগসূত্রে গঠিত এক মর্যাদাশীল সত্তা। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য মানবাধিকার তত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ সেখানে মানবতার আধ্যাত্মিক দিককে একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে।

গাজা, পাশ্চাত্য মানবাধিকার ও বাস্তবতা
আজ আমরা গাজায় যেসব মর্মান্তিক দৃশ্য দেখছি, তা প্রমাণ করে—আধুনিক পশ্চিমা মানবাধিকার এমনকি মানুষের জীবনের ন্যূনতম অধিকার—জীবিত থাকার অধিকারটুকুও রক্ষা করতে ব্যর্থ। সেখানে তো মানবতার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অধিকার দূর অস্ত!

রিসালায়ে হুকূক থেকে কিছু বাণী
“আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করুন! জেনে রাখো, প্রভুর তোমার উপর এমন অধিকার রয়েছে, যা তোমার গোটা সত্তাকে ঘিরে রেখেছে। তোমার প্রতিটি চলন-বলন, প্রতিটি অবস্থান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, এমনকি তুমি যেসব বস্তু ব্যবহার কর—সবই আল্লাহর অধিকার দ্বারা পরিবেষ্টিত।
এই অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আল্লাহর নিজস্ব অধিকার, যেটা সমস্ত অধিকার ও দায়িত্বের মূল ভিত্তি। এরপর রয়েছে তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকার—চোখ, কান, হাত, পা, পেট…
আবার তোমার কাজেরও অধিকার রয়েছে—যেমন নামাজ, রোজা, দান, কোরবানি। এরপর রয়েছে অন্যান্য মানুষের অধিকার—তোমার ঊর্ধ্বতনদের অধিকার, অধীনস্থদের অধিকার, আত্মীয়-পরিজনের অধিকার।”

ইমামের দৃষ্টিতে মানবাধিকার—আত্মার মর্যাদা থেকে শুরু করে সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতি দায়িত্ববোধ পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি এক টুকরো তুলসী পাতায় বসে থাকা একটি জুতোপোকাও এই অধিকার থেকে বাদ পড়ে না!

শিয়া মুসলমানরা এমন একজন ইমামের অনুসারী হওয়ার গৌরব লাভ করেছে, যিনি মানবাধিকারের আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন—কেবল কথায় নয়, বাস্তবে, সমাজের প্রতিটি স্তরে।

মানবাধিকারের এই আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্যের মেকি সনদের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক, গভীর এবং মুক্তির পথে আলোকবর্তিকা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha