শুক্রবার ১ আগস্ট ২০২৫ - ১১:৫৬
নামাজ শেষে একজন শিয়া ও একজন সুন্নি আলেমের সৌহার্দপূর্ণ দৃশ্য

প্রতি বছর সফর মাসের ২০ তারিখে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর চেহলুম বা আরবাইন উপলক্ষে যে মহামিছিল ইরাকের কারবালা শহরে জমায়েত হয়, তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শান্তিপূর্ণ মানবিক জমায়েতগুলোর একটি। লাখ নয়, কোটি মানুষের পদচারণে মুখরিত হয় কারবালার পথ—বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল, মত বা মাজহাবের ভেদাভেদ ছাপিয়ে সবাই এসে দাঁড়ান একই ব্যানারে: “হুসাইন মিন্নি ও আনা মিন হুসাইন” — হুসাইন আমার, আমিও হুসাইনের।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই জিয়ারত শুধু শিয়াদের নয়, বরং সুন্নি, খ্রিস্টান এমনকি অমুসলিমরাও ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতি সম্মান জানাতে অংশ নেন। কারণ, ইমাম হুসাইন (আ.) শুধুমাত্র এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নন—তিনি হচ্ছেন মানবতার শাশ্বত ন্যায়ের প্রতীক।

মারজা ও ইসলামী চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে আরবাইন
গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলী আল সিস্তানি বলেন,

“কারবালা এক ধর্মীয় তীর্থ নয় কেবল, এটি এক নৈতিক ও মানবিক বিপ্লব। হুসাইন হচ্ছেন সেই চেতনার নাম, যা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে শেখায়।”

আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি বলেন,

“আজ উম্মাহর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল ঐক্য। কারবালা সেই ঐক্যের মঞ্চ হতে পারে, যেখানে শিয়া ও সুন্নি উভয়েই একই বার্তা গ্রহণ করতে পারেন: ‘লা উম্মাহ ইল্লা বি ওহদাহ’— ঐক্য ছাড়া কোনো উম্মাহ নয়।”

ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছিলেন,

“আমাদের শত্রুরা চায় আমরা বিভক্ত থাকি। কিন্তু হুসাইন (আ.) আমাদের শেখান কিভাবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে হয়। হুসাইন শুধুই শিয়াদের নন—তিনি উম্মাহর।”

ইমাম হুসাইন (আ.) ও কারবালা: শিয়া-সুন্নি ঐক্যের ভিত্তি
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইমাম হুসাইনের বিপ্লবীয় শিক্ষা কোন একক গোষ্ঠীর মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর শাহাদতের দিন, ১০ মহররম, বিশ্বব্যাপী সুন্নি ও শিয়া উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ গভীর শ্রদ্ধা ও দুঃখে দিনটি পালন করেন।

সুন্নি ইতিহাসবিদ ইবন কাসির তাঁর 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া' গ্রন্থে লিখেছেন, “ইমাম হুসাইনের শাহাদত ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য চিরস্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছে।”

গাজার মতো নিপীড়িত মুসলিমদের মুক্তির পথ হতে পারে এই ঐক্য
বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যা, ইয়েমেনে ভয়াবহ মানবিক সংকট কিংবা কাশ্মীরের নিপীড়ন—সবক্ষেত্রেই দেখা যায় মুসলিমদের ভাঙা ঐক্য ও দুর্বল প্রতিরোধ। অথচ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর চেতনা শিক্ষা দেয়, কিভাবে অল্পসংখ্যক সাথী নিয়ে বৃহৎ জুলুম শক্তিকে রুখে দাঁড়াতে হয়।

আয়াতুল্লাহ বাহরুল উলুমের মতে, “শিয়া-সুন্নি ভ্রাতৃত্বই আজ সবচেয়ে বড় হিজবুল্লাহ (আল্লাহর পার্টি)। ঐক্যের শক্তিতে আমরা শুধু ইতিহাস বদলাতে পারি না, বরং গাজা ও অন্যত্র মুসলিম নির্যাতনের ইতি টানতে পারি।”

ইমাম হুসাইনের (আ.) চেতনা তাই শুধু ইতিহাস নয়, এটি আজকের এক কার্যকর আদর্শ।

আরবাইন: সন্ত্রাস, সাম্রাজ্যবাদ ও বিভক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন প্রতিরোধ
পবিত্র কারবালার পথে ১৪০০ কিলোমিটার হাঁটেন অনেক যিয়ারতকারী। শত শত ফ্রি খাবারের তাবু, চিকিৎসা সেবা, পানীয় সরবরাহ—সবই হয় সাধারণ মানুষের হাতে। কোনো সরকার নয়, কোনো জাতিসংঘ নয়—মানবতা নিজেই সংগঠিত হয় এই সফরে।

এটাই হল হুসাইনি সভ্যতা। যেখানে নিপীড়িত মানুষেরা একত্র হয়ে বলতে পারেন: “হায় হুসাইন” মানেই যেন ন্যায়বিচার!”

এবং সেই আহ্বান এখন শুধু ইরাকে নয়, বরং গাজার ধ্বংসস্তূপেও ধ্বনিত হয়—“মাজলুমের পাশে দাঁড়াও”।

পরিসমাপ্তি, কারবালা কোনো একক গোষ্ঠীর গন্তব্য নয়—এটি চেতনার কেন্দ্র, শিয়া-সুন্নি ঐক্যের উৎস এবং গাজাসহ বিশ্বের সব মাজলুম মুসলিমের মুক্তির সোপান। আরবাইনের জিয়ারত একটি আত্মিক বিপ্লব, যা বিভক্তি ভেঙে ঐক্য গড়তে শেখায়।

ইমাম হুসাইন (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন: “জুলুমের বিরুদ্ধে নীরবতা হারাম।” তাই কারবালা শুধু অতীত নয়, এটি এক চলমান বিপ্লব—যার ব্যানারে আজও সব ন্যায়ের পক্ষে মানুষ একত্রিত হচ্ছে।

লিখেছেন: উম্মে যাহরা আহমেদ

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha