হাওজা নিউজ এজেন্সি: আরবাইনের পায়ে হেঁটে যাত্রা কেবল দূরত্বে মাপা যায় না—এটি মাপা হয় হৃদয়ের স্পন্দনে। এই পথ শুধু ধুলোমাখা রাস্তা নয়; এটি ভালোবাসা ও ভক্তির এক নদী, যা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে গড়িয়ে আসে হোসেইন (আ.)-এর দিকে। এখানে মনে হয় আকাশ নেমে এসেছে যাত্রীদের সঙ্গ দিতে—তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, লাব্বাইক ইয়া হোসাইন উচ্চারণ করতে।
প্রতিটি পদক্ষেপই একটি গল্প
মায়ের গল্প, যিনি ছোট্ট সন্তানের হাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছেন, যাতে এই ভালোবাসা উত্তরাধিকার হিসেবে পৌঁছে দিতে পারেন।
যুবকের গল্প, যার জুতো জীর্ণ, পায়ে ফোস্কা, কিন্তু চোখের দীপ্তি বলে দেয়—সব কষ্ট একটিমাত্র সম্ভাষণের বিনিময়ে সঁপে দিয়েছে।
বৃদ্ধের গল্প, যিনি কয়েক কদম পরপর বুকের উপর হাত রেখে সালাম দেন—যেন পুরো পথটিই তিনি প্রিয়জনের দরবারে অবস্থান করছেন।
পথজুড়ে মুকিব (সেবাকেন্দ্র) গুলো যাত্রীদের জন্য খোলা বাহুর মতো। ইরাকি নারী-পুরুষরা গরম রুটি, মিষ্টি চা, ঠান্ডা পানি কিংবা শুধু একটি আন্তরিক হাসি দিয়ে ক্লান্তি মুছে দেন। তাদের হাত শক্ত, কিন্তু চোখ ভরা আনন্দাশ্রু—সেবা করেন কোনো বাধ্যবাধকতায় নয়, ভালোবাসায়।
এখানে অশ্রু বিরহের, আর হাসি মিলনের। প্রতিটি যাত্রীর আছে নিজস্ব কোনো গোপন ইচ্ছে, প্রার্থনা বা অঙ্গীকার—যা কেবল কারবালায় পৌঁছেই শান্ত হয়। এখানে আকাশ ও মাটি যেন মিলেছে এক বিন্দুতে; যেখানে সব সীমারেখা মুছে যায়, আর কেবল একটি নাম বেঁচে থাকে—হোসেইন।
পিতৃগৃহ
বলা হয়, মেয়েরা বাবার প্রতি বিশেষ অনুরাগী—প্রাণ দিতে রাজি, কিন্তু বাবার পায়ে কাঁটা বিঁধুক তা সহ্য নয়। পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, পিতৃগৃহের স্বস্তি অন্য কোথাও নেই। এই সম্পর্কের আসল রূপ দেখতে হলে যেতে হবে নাজাফে। এখানে ইমাম আলী (আ.)-এর রওজায় ছোট-বড় মেয়েরা অবাধে দৌড়ায়, কাছে এসে হাসিমুখে থেমে দাঁড়ায়।
তাদের হাসিতে খুশি হয়ে খাদেমরা ছোট উপহার দেন—যেন পিতৃস্নেহ ও যত্নের এক অনন্ত প্রতীক।
প্রথম জিয়ারতকারী
এক তরুণী, যার আগে ধর্মীয় আচার-অনুশীলন তেমন ছিল না, হোসেইনের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে এই যাত্রায় এসেছে। শুরুতে মনে হচ্ছিল কোনো বিশেষ অনুভূতি নেই, কিন্তু রওজার কাছে পৌঁছে নির্বাক হয়ে যায়, চোখ ভিজে ওঠে। মনে হয় অন্তরে এমন কিছু ঘটেছে যা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। তখনই সে উপলব্ধি করে—পিতার স্নেহ কোনো দূরত্ব চেনে না।
শোনা হয়েছে প্রার্থনা
ফাতিমা নামে এক তরুণী তিন বছর ধরে নাজাফে আসার জন্য প্রার্থনা করছিলেন। তার দুঃখ হয়তো অন্যদের কাছে তুচ্ছ, কিন্তু তার কাছে তা ছিল ভারী বোঝা। এখানে এসে তিনি এমনভাবে ‘দেখা’ বোধ করলেন, যা অন্য কোথাও অনুভব করেননি। গিঁট হয়তো এখনো খোলেনি, কিন্তু তিনি নিশ্চিত—কেউ তার হাত ধরে রেখেছে।
জাতিগত পরিচয়ের গর্ব
খোররামশহরের কয়েকজন তরুণী সাবলীল আরবিতে কথা বলায় অনেকেই ভেবেছিলেন তারা ইরাকি। তারা স্পষ্ট করে বললেন—তারা ইরানের আরব, এবং এ নিয়ে গর্বিত। ভাষা নয়, আত্মপরিচয় নির্ধারিত হয় মাটির সাথে হৃদয়ের বন্ধনে।
হারিয়ে যাওয়া ওড়না
এক তরুণী তার অসুস্থ দাদীর জন্য তাবারুক হিসেবে একটি সুন্দর ওড়না কিনেছিলেন, কিন্তু রওজা থেকে ফেরার পথে তা হারিয়ে যায়। সে কাঁদছিল, কিন্তু অভিজ্ঞ এক সহযাত্রী তাকে বললেন—"যদি কোনো কিছু রওজায় হারিয়ে যায়, খুঁজে ফিরো না; বুঝে নাও তোমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে, ইমাম সেটি নিজের কাছে রেখেছেন সময়মতো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।" এ কথা শুনে তার মন শান্ত হয়, অশ্রুর মাঝেও হাসি ফুটে ওঠে।
আপনার কমেন্ট