রবিবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ২০:২৬
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জীবনাদর্শে বুদ্ধি ও দ্বীনের পারস্পরিক সম্পর্ক

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জীবন ও শিক্ষা বুদ্ধি ও ঈমানের অমোঘ সম্পর্কের অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর মতে, মানুষের বুদ্ধিই ঈমানের পূর্বশর্ত, এবং বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ নিজের স্রষ্টাকে চিনতে পারে ও ভালো-মন্দ পৃথক করতে পারে। ইসলামিক শিক্ষার প্রসঙ্গে বুদ্ধি ও দ্বীনের সমন্বয়ই ফসল ও নৈতিকতা অর্জনের পথ প্রদর্শক।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: কিছু চিন্তাবিদ মনে করেন যে ঈমান এবং আকল (বুদ্ধি) একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাদের মতে, ঈমান বুদ্ধির উপরে—অর্থাৎ প্রথমে ঈমান আনতে হবে, তারপর বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর মতে, বুদ্ধিই ঈমানের আগে। তিনি বলেছেন,
فبالعقل عرف العباد خالقهم
অর্থাৎ—মানুষ তার বুদ্ধির মাধ্যমেই নিজের স্রষ্টাকে চেনে।

কোরআনে তাফাক্কুর ও তাদাব্বুর
কোরআন মানবজাতির জন্য হেদায়েতের গ্রন্থ। এতে সর্বত্র মানুষকে চিন্তা ও বুদ্ধি ব্যবহার করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। কোথাও আল্লাহ নবী ও ওলিদের উপস্থাপিত যুক্তিগুলো বর্ণনা করেছেন, আবার কোথাও যারা বুদ্ধি ব্যবহার করে না তাদেরকে “সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী” আখ্যা দিয়েছেন:

إِنَّ شَرَّ ٱلدَّوَآبِّ عِندَ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ
[সুরা আনফাল, আয়াত ৫৫]

এমনকি আল্লাহ যখন বলেন,
لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا
[সুরা আম্বিয়া, আয়াত ২২]

অর্থাৎ—“যদি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য থাকত, তবে অবশ্যই উভয়টি বিনষ্ট হয়ে যেত”—তখনও তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, যাতে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে তাঁর একত্ববাদ উপলব্ধি করে।

কোরআন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, ঈমানের ভিত্তিই বুদ্ধি। তাই বারবার অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করা হয়েছে।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর যুগে বুদ্ধি ও দ্বীনের বিকাশ
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর যুগ ইসলামি ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়। তাঁর দীর্ঘায়ু ও দীর্ঘ ইমামত, রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে (বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাসের সংঘর্ষ) তুলনামূলকভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। ফলে তিনি ইসলামের প্রচার, ফিকহের বিন্যাস, কোরআন ও হাদীস সংরক্ষণ এবং নানা বৈজ্ঞানিক-ধর্মীয় বিষয়ে শিষ্য তৈরির সুবর্ণ সুযোগ পান।

বুদ্ধির মর্যাদা
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,
إن الله ما خلق خلقاً أفضل من العقل
আল্লাহ বুদ্ধির চেয়ে উত্তম কিছু সৃষ্টি করেননি।

বুদ্ধি এমন এক নিয়ামত যা ফেরেশতাদের ঊর্ধ্বে মানুষকে স্থান দিতে পারে। আবার যদি মানুষ বুদ্ধিকে অবহেলা করে, তবে সে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ে।

তিনি এক হাদীসে ব্যাখ্যা করেছেন,
ফেরেশতাদেরকে কেবল বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে, কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। পশুদেরকে শুধু কামনা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি দেওয়া হয়নি। কিন্তু মানুষকে উভয়টি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং যার বুদ্ধি তার কামনার উপর বিজয়ী হবে, সে ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আর যার কামনা তার বুদ্ধিকে দমন করবে, সে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।

বুদ্ধি ও ঈমান
কিছু মতবাদ ও মতাদর্শী মনে করে ঈমান বুদ্ধির উপরে। অথচ ইমাম সাদিক (আ.) বলেন—বুদ্ধিই ঈমানের পূর্বশর্ত। তিনি বলেন,
فبالعقل عرف العباد خالقهم
অর্থাৎ—মানুষ তার বুদ্ধির মাধ্যমে নিজের প্রভুকে চিনে।

কোরআনও মানুষকে পৃথিবীর নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে আহ্বান করেছে।

বুদ্ধি ও ভালো-মন্দের জ্ঞান
কিছু মতবাদ মনে করে ভালো-মন্দ বোঝা শুধু শরীয়তের কাজ; বুদ্ধি এ ব্যাপারে অক্ষম। কিন্তু ইমাম সাদিক (আ.)-এর মতে, বুদ্ধি ভালো-মন্দ নির্ণয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন,
و عرفوا به الحسن من القبيح
মানুষ বুদ্ধির মাধ্যমেই ভালো ও মন্দকে চেনে।

এ কারণেই উসুলে দ্বীন (ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস) বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

বুদ্ধি ও দ্বীন একে অপরের সহচর
ইমাম সাদিক (আ.)-এর এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ যখন হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন, ফেরেশতা জিবরাঈল তাঁর কাছে তিনটি জিনিস নিয়ে আসলেন—বুদ্ধি, লজ্জা ও দ্বীন। আদম (আ.) বুদ্ধিকে বেছে নিলেন। তখন লজ্জা ও দ্বীন বলল: আমরা আল্লাহর নির্দেশে বুদ্ধির সাথেই থাকব।
[আল-মাহাসিন, আল-বারকী, খণ্ড ১, পৃ. ১৯১]

এর দ্বারা প্রমাণিত হয়—বুদ্ধি ও দ্বীন সবসময় পাশাপাশি থাকে।

ইসলামি জ্ঞানে বুদ্ধির ভূমিকা
ইমাম সাদিক (আ.) এমন ছাত্র তৈরি করেছিলেন যারা যুক্তি ও কালামের দুনিয়ায় অনন্য। তাঁর শিষ্য হিশাম ইবনে হাকাম ছিলেন অন্যতম প্রধান যুক্তিবিদ।

শুধু তাই নয়, শিয়া হাদীস সংকলনসমূহে প্রথম অধ্যায়ই “আকল ও জাহেল” বিষয়ক, যেখানে সুন্নি হাদীসগ্রন্থগুলোতে সাধারণত নামায, রোযা ইত্যাদি আমলী বিষয় দিয়ে শুরু হয়।

ফিকহে শিয়া মাযহাবে বুদ্ধি শরীয়তের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত, যা কিতাব ও সুন্নাহর সঙ্গে সমান্তরাল।

আহ্বান ও উপসংহার
ইমাম সাদিক (আ.)-এর শিক্ষা আমাদের বলে দেয়: বুদ্ধি ও দ্বীন আলাদা নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। বুদ্ধি ছাড়া ঈমানের ভিত্তি দুর্বল, আর শাস্ত্রীয় নির্দেশনা ছাড়া বুদ্ধি সীমিত।

আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেছেন, “আল্লাহ বুদ্ধিগুলোকে তাঁর সত্তার সব রহস্য অনুধাবন করাননি, তবে প্রয়োজনীয় মাত্রায় জ্ঞান লাভে বাধা-প্রতিবন্ধকও রাখেননি।”
[নাহজুল বালাগা, খুতবা ৪৯]

তাই আমাদের কর্তব্য হলো—ইমাম সাদিক (আ.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে, আল্লাহপ্রদত্ত এই মহান নিয়ামত বুদ্ধি ব্যবহার করা এবং এর মাধ্যমে দ্বীনের হেফাজত ও প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha