হাওজা নিউজ এজেন্সি: মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর এই নির্মম বাস্তবতা কেবল কূটনৈতিক সমঝোতার ফল নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক জটিলতার কারণে উদ্ভূত।
রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও ক্ষমতার রক্ষা
অনেক আরব শাসকের প্রধান লক্ষ্য হলো ক্ষমতার রক্ষা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শাসকগোষ্ঠী নিজ ক্ষমতা নিশ্চিত করতে প্রায়শই বাইরের শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে। জর্ডানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শহীদ আল-খলিল বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কেও নিহিত।”
ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া বা তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন প্রায়শই একটি নিরাপত্তার বীমা হিসেবে কাজ করে। শাসকরা অভ্যন্তরীণ বিরোধ মোকাবিলার জন্য বাইরের শক্তির সমর্থনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
অর্থনৈতিক ও সামরিক নির্ভরতা
অনেক আরব রাষ্ট্র সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া মুখ বন্ধ করে মেনে নেয়।
ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ফুয়াদ ইজদি দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলি হামলার কথা ইঙ্গিত করে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আলোচনার আড়ালে হামাস নেতাদের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে, যা পরবর্তীতে ইসরায়েলের হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়।”
কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক চুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রকল্প এ নির্ভরতার প্রতিফলন। শাসকরা প্রায়শই আমেরিকার সামরিক সহায়তা ও অর্থায়নের বিনিময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার শর্ত মেনে নেয়।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব ও জনগণের ভূমিকা
দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসন, দুর্নীতি ও নাগরিক অংশগ্রহণের সীমিত সুযোগ আরব জনগণকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ কমিয়ে দেয়। ইরাক, লেবানন বা মিশরের উদাহরণে দেখা গেছে, জনগণ প্রায়শই শাসকগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল থাকে। শিক্ষার অভাব, গণমাধ্যমের সীমিত স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সচেতনতার ঘাটতি সামাজিক সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
কূটনৈতিক চাপ ও মিডিয়ার ভূমিকা
পশ্চিমা মিডিয়া ও কূটনৈতিক চাপ অনেক আরব রাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রভাবিত করেছে। ফরাসি বিশ্লেষক ফিলিপ লেগ্রান্ড বলেন, “শাসকরা প্রায়শই পশ্চিমা মিডিয়ার চাপ ও আন্তর্জাতিক ফোরামের নির্দেশনায় পদক্ষেপ নেয়।” আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার রিপোর্ট ও বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও প্রায়শই নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।
অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও শত্রুপক্ষের প্রভাব
রাজনৈতিক বিভাজন এবং অভ্যন্তরীণ শত্রুতা (যেমন সৌদি–ইরান বিরোধ, লেবানন ও সিরিয়ার বিভাজন) শাসকদের বাইরের শক্তির ওপর নির্ভরশীল করে। ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা প্রায়শই অভ্যন্তরীণ একীকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও সমাধানের পথ
সংক্ষেপে বলা যায়, আরব বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র রাজনৈতিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নির্ভরতা, ক্ষমতার রক্ষা, আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে ইসরায়েল-আমেরিকার দাসত্ব মেনে চলছে।
বিশ্লেষকরা মনে করান, “আরব বিশ্বের মুক্তি ও স্বার্থের জন্য একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, নাগরিক অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এবং স্বাধীন কূটনীতি।”
এটি না হলে, দেশের স্বাধীনতা কেবল নথি ও প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং জনগণের আস্থা ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে থাকবে।
আপনার কমেন্ট