হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমামত বিষয়ে এমন প্রশ্ন শুধু সাধারণ পাঠকের নয়, বরং বহু গবেষকের মনেও এসেছে। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কুরআনের প্রকৃতি, নাযিল হওয়ার ধারা, এবং হিদায়াত প্রদানের পদ্ধতিকে গভীরভাবে বুঝতে হবে।
এই বিষয়েই বিশ্লেষণ করেছেন হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রেজা পুর-ইসমাঈল—যিনি দীর্ঘদিন ধরে আকীদাগত প্রশ্ন-সন্দেহের জবাব প্রদানে সক্রিয়। তাঁর বক্তব্য আমাদেরকে এই জটিল প্রশ্নের অন্তর্নিহিত হিকমতগুলো উপলব্ধিতে সহায়তা করবে।
কুরআনের প্রকৃতি: পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত, তবে সীমাহীন বিস্তারিত নয়
প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে—কুরআন মূলত হিদায়াতের কিতাব। এটি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোয়, ভ্রান্তি থেকে সত্যে আনার পথনির্দেশিকা। কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ, যা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ওপর নাযিল হয়েছে। তাই কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি যুগ ও প্রজন্মের জন্য হিদায়াত এতে নিহিত রয়েছে।
কিন্তু কুরআন সব কিছু খুঁটিনাটি আকারে বর্ণনা করেনি। অর্থাৎ, কুরআনকে একটি “বিশদ তালিকা” আকারে কল্পনা করা ভুল। বরং এটি মৌলিক কাঠামো ও সার্বজনীন দিকনির্দেশনা দিয়েছে, আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব রেখেছে নবী করিম (সা.)–এর ওপর।
নামাযের উদাহরণ
কুরআনে বারবার বলা হয়েছে: «أقیموا الصلاة»—তোমরা নামায কায়েম করো। কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই—ফজর দুই রাকাত, যোহর চার রাকাত, কিংবা রুকু-সিজদাহর নিয়ম কেমন হবে। এগুলো রাসূল (সা.)–এর বাণী ও আমল দ্বারা আমাদের কাছে পৌঁছেছে।
নৈতিক শিক্ষা
কুরআন কিছু ছোটখাটো নৈতিক নির্দেশনা স্পষ্টভাবে দিয়েছে, যেমন—সততা, ধৈর্য, পরিশ্রম ইত্যাদি। আবার এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও সামাজিক দিক আছে, যা সরাসরি কুরআনে উল্লেখিত হয়নি।
সুতরাং এটা বলা যাবে না যে, কোনো বিষয় যদি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে কুরআনে অবশ্যই তা নামসহ বিস্তারিত আসবে। কুরআনের নিজস্ব পদ্ধতি হলো—কিছু বিষয় বিস্তারিতভাবে বলা, আর কিছু বিষয় নীতিগতভাবে উল্লেখ করে বাকি অংশ নবীর ওপর ছেড়ে দেওয়া।
নবীদের নাম: মর্যাদার কারণে নয়, হিদায়াতের প্রেক্ষাপটে
একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো—সব নবীর নাম কুরআনে আছে। বাস্তবে, কুরআনে অসংখ্য নবীর নামই আসেনি। আর যাদের নাম এসেছে, তাও মর্যাদা বা গুরুত্বের ভিত্তিতে নয়, বরং হিদায়াত প্রদানের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে।
উদাহরণ: মূসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)
হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাম কুরআনে এসেছে মাত্র ৪ বার। অথচ হযরত মূসা (আ.)–এর নাম এসেছে ২০ বারেরও বেশি।
তাহলে কি এর মানে মূসা (আ.)–এর মর্যাদা বেশি? না, মোটেও নয়। বরং এর কারণ হলো—মূসা (আ.)–এর কাহিনী ও বনী ইসরাইলের ঘটনা সেই সময়কার আরব সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল। তাই তাঁর কাহিনী বারবার এসেছে। অন্যদিকে, নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবন নিজেই উম্মাহর সামনে জীবন্তভাবে বিদ্যমান ছিল। তাই তাঁর নাম কমবার আসলেও গুরুত্ব কমেনি।
অতএব, নামের উল্লেখ মানেই মর্যাদা নয়—এটি কুরআনের স্পষ্ট বাস্তবতা।
ইমামত: নাম নয়, বরং কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য
যদিও ইমামদের নাম সরাসরি আসেনি, কুরআন ইমামতের মূল কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে দিয়েছে।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণনা আছে:
• ইমামের চরিত্র ও গুণাবলি কেমন হবে,
• কোন শর্তে তিনি নির্বাচিত হবেন,
• তাঁর দায়িত্ব, নেতৃত্ব ও হিদায়াতের মর্যাদা কী হবে।
এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হলো আয়াতুল্লাহ শাইখ মুহসিন আরাকি–এর রচিত “নসুসে ইমামত ফি আল-কুরআন”। এখানে ইমামত সংক্রান্ত সব আয়াত একত্রিত করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কীভাবে কুরআন ইমামতের ভিত্তি নির্মাণ করেছে।
অতএব, নাম আসেনি মানেই ইমামত অস্বীকৃত নয়; বরং কুরআন ইমামতের মূল নীতিমালা দিয়েছে, নামগুলো রাসূল (সা.)–এর হাদিসে পরিষ্কার হয়েছে।
কেন নামগুলো সরাসরি আসেনি? একটি গভীর হিকমত
বিখ্যাত আলেম মারহুম আল্লামা আসকারি (রহ.) বলেন—কুরআনের নাযিল হওয়ার ধরনই এমন ছিল যাতে এটি চিরকাল তাহরিফ (বিকৃতি ও পরিবর্তন) থেকে নিরাপদ থাকে।
কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা শুধু অলৌকিক পাহারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল:
• নবী করিম (সা.)–এর নিয়মিত তিলাওয়াত,
• সাহাবাদের মুখস্থ করা,
• কাতিবদের লেখা,
• এবং আল্লাহর বিশেষ নাযিলের শৈলী।
এসব মিলে কুরআনকে বিকৃতির হাত থেকে সুরক্ষিত করেছে।
এখন কল্পনা করুন—যদি কুরআনে ইমামদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত? তখন রাজনৈতিক স্বার্থ, দলীয় বিরোধ ও শত্রুতার কারণে নামগুলো বিকৃত করার প্রবল তাগিদ তৈরি হতো। তাই একটি সম্ভাব্য হিকমত হলো—আল্লাহ ইমামদের নাম সরাসরি উল্লেখ করেননি, বরং ইমামতের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।
প্রচলিত একটি ভুল ধারণা: “কুরআনে নেই মানে সত্য নয়”
অনেকে মনে করেন, কোনো বিষয় কুরআনে সরাসরি না থাকলে সেটি সত্য নয়। এই যুক্তি ভুল।
কারণ:
বহু আকীদাহ, ফিকহি হুকুম, নৈতিক শিক্ষা—যা শিয়া-সুন্নি উভয়ের কাছেই স্বীকৃত—সরাসরি কুরআনে উল্লেখ নেই।
যেমন নামাযের রাকাত সংখ্যা, যাকাতের বিস্তারিত, বা হজের খুঁটিনাটি—সবই হাদিস ও রাসূল (সা.)–এর ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে।
তাহলে ইমামদের নাম সরাসরি কুরআনে না আসা মানেই ইমামত বাতিল নয়।
পরিসমাপ্তি: কুরআনের লক্ষ্য হলো মানব জাতিকে হিদায়াতের মৌলিক কাঠামো দেওয়া—প্রতিটি খুঁটিনাটি নয়। বিশদ ব্যাখ্যা ও নামগুলোর দায়িত্ব রাসূল (সা.)–এর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
অতএব, সত্যের সন্ধানকারীকে শুধু কুরআনের টেক্সটে সীমাবদ্ধ না থেকে—হাদিস, আহলে বাইত (আ.)–এর বাণী, প্রমাণিত ঐতিহাসিক দলিল এবং যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহার করতে হবে।
এসব মিলেই প্রমাণিত হয়—আহলে বাইত (আ.) ও ইমামদের হাক্কানি নেতৃত্ব ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আপনার কমেন্ট