শনিবার ৪ অক্টোবর ২০২৫ - ১১:১১
সহিংসতা—নারীদের পতনের দিকে ঠেলে দেওয়া এক ধ্বংসাত্মক আচরণ

দেজফুল শহরের হাওজায়ে ইলমিয়া উম্মে আবিহা (সা.আ.)-এর অধ্যাপক ও গবেষণা বিভাগের সহকারী আতেনা শহরোজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্বের অন্যতম ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা শুধু নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, বরং পরিবার ও সমাজের জন্যও একটি গুরুতর হুমকি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আতেনা শহরোজ বলেন, সহিংসতার বিস্তার ও স্থায়িত্বের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, দুর্বল আইনগত সুরক্ষা, নারীর শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং সামাজিক ও মানসিক সহায়তার অভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, নারীর প্রতি সহিংসতা হলো এমন যে কোনো কাজ বা হুমকি, যা লিঙ্গভিত্তিক এবং যার ফলে নারীর শারীরিক, মানসিক, যৌন ক্ষতি কিংবা স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়।

সহিংসতার বিভিন্ন রূপ
শারীরিক সহিংসতা:
তিনি বলেন, এটি সবচেয়ে দৃশ্যমান ও সহজে শনাক্তযোগ্য সহিংসতার ধরন। এতে মারধর, ঘরে আটকে রাখা, ইচ্ছাকৃত দগ্ধ করা, নির্যাতন বা শারীরিক আঘাত অন্তর্ভুক্ত। এর পরিণতি শুধু সাময়িক ক্ষত বা ভাঙা হাড় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক অক্ষমতা ও গভীর মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করে।

মানসিক ও আবেগিক সহিংসতা:
এটি বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরনের সহিংসতা। এতে অবমাননা, হুমকি, অপমান, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, অবহেলা, ভালোবাসা থেকে বঞ্চনা ও সামাজিক সম্পর্ক সীমিত করার মতো আচরণ অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে উদ্বেগ, হতাশা, অনিদ্রা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হয়।

যৌন সহিংসতা:
শহরোজ বলেন, এতে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ, মৌখিক বা শারীরিক হয়রানি, অপমান বা হুমকি অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক ট্যাবু ও সম্মানহানির ভয়ে নারীরা সাধারণত এটি প্রকাশ করেন না। এর প্রভাব শুধু শারীরিক ক্ষতি বা রোগ সংক্রমণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আত্মমর্যাদা হারানো, ভয়, হতাশা ও গভীর মানসিক আঘাতও সৃষ্টি করে।

অর্থনৈতিক সহিংসতা:
তিনি উল্লেখ করেন, অনেক নারী আর্থিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হন। এতে চাকরি বা শিক্ষার সুযোগ বন্ধ করা, আয় বা সম্পদে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, খরচ নিয়ন্ত্রণ বা ন্যায্য ভরণপোষণ না দেওয়া অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং অন্য সহিংসতার শিকার হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারেন না।

সামাজিক ও কাঠামোগত সহিংসতা: এতে নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণে সামাজিক-আইনগত বাধা সৃষ্টি হয়। বৈষম্যমূলক আইন, সীমাবদ্ধ প্রথা, সিদ্ধান্তগ্রহণে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নারীর মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।

মৌখিক সহিংসতা:
অপমানজনক ভাষা, গালি, তিরস্কার, ব্যঙ্গ বা হুমকির ব্যবহার নারীর আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন করে এবং ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে গুরুতর মানসিক সমস্যার কারণ হয়।

প্রতিরোধের উপায়
▫️আতেনা শহরোজ বলেন, সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত সামাজিক, শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

▫️শৈশব থেকেই সম্মান, যোগাযোগ দক্ষতা, রাগ নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধানের শিক্ষা দেওয়া জরুরি।

▫️বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ ও যৌন ও অর্থনৈতিক সহিংসতাকে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার।

▫️নারীদের নিরাপদ ও গোপন রিপোর্টিংয়ের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

▫️স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্রে সমাজকর্মী ও মনোবিদদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

▫️নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন অত্যন্ত জরুরি—চাকরির সুযোগ, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা হওয়ার সহায়তা তাদের আর্থিক নির্ভরতা কমাবে এবং সহিংসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম করবে।

▫️সামাজিকভাবে লিঙ্গবৈষম্যমূলক ধ্যানধারণা বদলাতে হবে। মিডিয়া ও সংস্কৃতিতে সফল নারীদের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা, সহিংসতার ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতা তৈরি এবং সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি শেষে বলেন, সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, মনো-পরামর্শ এবং পুনর্বাসন সেবা সম্প্রসারণ রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই দায়িত্ব।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha