বুধবার ৮ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:৪২
মোহরানার সংকট থেকে মুক্তির পথ

হুজ্জাতুল ইসলাম আবদালি “মোহরানা” বিষয়ে লিখিত এক চিন্তাশীল নিবন্ধে বলেন—মোহরানাকে “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” (অর্থাৎ স্বামী সক্ষম হলে পরিশোধযোগ্য) করা মোটেও এই সংকটের প্রকৃত সমাধান নয়। প্রকৃত সমাধান নিহিত রয়েছে ইসলামের আদর্শে ফিরে যাওয়া এবং স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মোহরানা নির্ধারণ করার মধ্যে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: সম্প্রতি সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “আন্দাল-ইস্তেতাআহ মোহরানা” নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, যদি মোহরানাকে স্বামীর সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া যায়, তাহলে মোহরানা-জনিত সামাজিক সমস্যা ও কারাবন্দিদের সমস্যা কমবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটাই কি সত্যিই সমাধান? নাকি সমস্যাকে কেবল অন্য আকারে স্থায়ী করা হবে?

মোহরানার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ভুল প্রয়োগ
ইসলামী দৃষ্টিতে মোহরানা হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও আর্থিক দায়িত্ববোধের প্রতীক। এটি কখনোই প্রতিশোধমূলক বা শর্তসাপেক্ষ ঋণ নয়। সুতরাং যদি এমন মোহরানা নির্ধারণ করা হয় যা স্বামীর সাধ্যের বাইরে, তবে তা শরিয়তসম্মত হয় না।

যখন কেউ নিজের আর্থিক সক্ষমতার বাইরে কোনো শর্তে সম্মতি দেয়, ইসলামী ফিকহ অনুযায়ী তাকে “সফিহ” (অর্থনৈতিকভাবে অপরিপক্ব) বলা হয়। এ অবস্থায় এমন শর্তযুক্ত বিবাহকে বৈধ বলা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ একটি অকার্যকর শর্ত গোটা চুক্তিকেই সমস্যাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।

অতএব, সমস্যার মূলে সমাধান হলো—মোহরানা এমন হতে হবে যা বাস্তবসম্মত ও স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় সচেতনতা, সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত পরিবর্তন।

নবী ও আহলে বাইতের আদর্শ
ইসলামী ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না যে নবী করিম (সা.) বা ইমামগণ “নসিয়াহ” (বিলম্বিত) মোহরানা নির্ধারণ করেছেন। বরং বিবাহকে একপ্রকার লেনদেন বা চুক্তির রূপে বিবেচনা করা হয়েছে—যেখানে যেমন ক্রেতা ও বিক্রেতা ইজাব ও কবুলের মুহূর্তে পণ্য ও মূল্য বিনিময় করেন, তেমনি বিবাহে ইজাব ও কবুলের সঙ্গে সঙ্গেই মোহরানা স্ত্রীর প্রাপ্য হয়ে যায়।

যখন দাম্পত্য সম্পর্ক পূর্ণতা পায়, তখন স্বামীর ওপর পুরো মোহরানা প্রদানের দায় বর্তায়।

অতএব, যদি আমরা নবী-ইমামদের আদর্শ অনুসরণ করতে চাই, তবে বিবাহের সময়ই মোহরানা প্রদান করা উচিত। এভাবে দিলে মোহরানাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক ও আইনি জটিলতা তৈরি হয়, তা মূল থেকেই দূর করা সম্ভব হবে।

বাস্তব সুফল ও পারিবারিক প্রভাব
বাস্তব মোহরানা নির্ধারণ: স্বামীর পক্ষে তৎক্ষণাৎ প্রদেয় পরিমাণে মোহরানা নির্ধারণ করলে তা হবে বাস্তব ও অর্থবহ। এতে মোহরানার প্রতীকী ও ধর্মীয় মূল্য পুনরুদ্ধার হবে।

পারস্পরিক দায়িত্ববোধ: যেমন স্ত্রী বিবাহের উপহার সামগ্রী নিয়ে সংসার শুরুতে ভূমিকা রাখে, তেমনি স্বামী মোহরানা প্রদানের মাধ্যমে তার দায়িত্বশীলতা প্রমাণ করে। এতে উভয়ের সম্মান ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়।

বিবাহ উপহার সামগ্রী  প্রথা হ্রাস: ইসলামী দৃষ্টিতে মোহরানার অর্থ সংসারের প্রাথমিক ব্যয়ে ব্যবহার করা যায়। এভাবে মোহরানা প্রদান করলে বিবাহে উপহার সামগ্রীর বাড়তি বোঝাও হ্রাস পায়, ফলে সমাজে বিবাহ সহজতর হয়।

বিবাহে স্থিতিশীলতা:মোহরানাকে নিয়ে স্ত্রীর চাপ বা প্রতিশোধমূলক ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পায়, যা পরিবারে শান্তি ও স্থিতি আনে। আদালতে মোহরানা সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও কমে আসে।

পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ২৪০০ জন পুরুষ মোহরানা সংক্রান্ত দেনার দায়ে কারাবন্দি। দেশের অন্যান্য আর্থিক অপরাধ বা দেনাদারির তুলনায় এটি খুব বড় সংখ্যা নয়। তবে সমস্যা হলো—অধিকাংশ মোহরানাই স্বামীর প্রকৃত সক্ষমতার বহু গুণ বেশি নির্ধারিত হয়।

ফলে এটি এমন এক অসম চুক্তিতে পরিণত হয়, যেখানে স্ত্রী তার দায়িত্ব পালন করে কিন্তু স্বামী সেই আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণে সম্পূর্ণ অক্ষম। ইসলামী ন্যায়ের দৃষ্টিতে এটি “একতরফা লেনদেন” বা “আকদে গারারি” (অস্পষ্ট চুক্তি), যা অনুচিত ও অবৈধ।

সামর্থ্য নির্ধারণের প্রশ্ন
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন—স্বামীর আর্থিক সামর্থ্য কীভাবে নির্ধারণ করা যাবে?
উত্তর হলো, যদি মোহরানা “তৎক্ষণাৎ প্রদেয়” হয়, তবে স্বামী যে মুহূর্তে তা পরিশোধ করছে, সেটিই তার সক্ষমতার প্রমাণ। যেমন ক্রেতা যখন পণ্যের দাম দেয়, তখন তার পরিশোধ ক্ষমতাই তার সামর্থ্য নির্ধারণ করে।

নারীদের দৃষ্টিকোণ ও সামাজিক ভারসাম্য
তবে মনে রাখতে হবে—যদি মোহরানাকে একেবারে “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” শর্তে সীমাবদ্ধ করা হয়, তবে অনেক নারীই বিবাহে আগ্রহ হারাবে। তারা এমন শর্তে রাজি হবে না, যেখানে স্বামী ইচ্ছা করলে বা সামর্থ্য হলে তবেই মোহরানা দেবে। এতে বিবাহের হার কমবে এবং সমাজে আরেকটি নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হবে।

অতএব, কোনো সমাধানই এমন হওয়া উচিত নয় যা সমস্যার একটি দিক কমিয়ে অন্য দিক বাড়িয়ে দেয়।

আইন, রেজিস্ট্রি ও সামাজিক দায়িত্ব
বর্তমানে বিবাহ নিবন্ধনকারী কার্যালয়গুলোতে স্বামী-স্ত্রীর সম্মতিতে মোহরানাকে “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” আকারে নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। তবে এসব অফিসের কর্তব্য হলো—নবদম্পতিদের মোহরানার অতিরিক্ত ভার ও তার সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা।

আইন প্রণেতারাও চাইলে সরাসরি “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” বাধ্যতামূলক করার পরিবর্তে মোহরানার পরিমাণকে যুক্তিসংগত ও স্বামী-সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার দিকেই মনোযোগ দিতে পারেন। এতে সমাজ স্বাভাবিকভাবে সঠিক পথে এগিয়ে যাবে এবং মোহরানা-সংক্রান্ত জটিলতাও কমবে।

ইসলামী দৃষ্টিতে স্বামীর সাধ্যের ঊর্ধ্বে মোহরানা নির্ধারণ করা বৈধ নয়। কিন্তু সেই অযৌক্তিক মোহরানাকে বৈধ করার জন্য “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” শর্ত সংযোজন করাও ইসলামী নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ হয় চুক্তির পূর্বে, আর “আন্দাল-ইস্তেতাআহ” শর্ত যুক্ত হয় চুক্তির পরে—ফলে এতে চুক্তির স্পষ্টতা নষ্ট হয়ে যায় এবং আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়।

অতএব, ইসলামের নীতিমালায় ফিরে গিয়ে—
•বাস্তবসম্মত মোহরানা   নির্ধারণ,

•অতিরিক্ত মোহরানা সংস্কৃতির অবসান,

•সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি,

•এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধ জোরদার

এই চারটি পদক্ষেপই হতে পারে মোহরানা-সংকট থেকে মুক্তির প্রকৃত ও টেকসই পথ।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha