বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০২৫ - ১৩:২১
কীভাবে বুঝব, আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট কি না?

আল্লাহর সন্তুষ্টি তখনই বাস্তবায়িত হয়, যখন বান্দাও আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে; চাই তা হোক সুখ-সমৃদ্ধির সময়, অথবা অভাব, দুঃখ ও পরীক্ষার মুহূর্তে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই সন্তুষ্টি বা রেজা বিল্লাহ (رضا بالله)-এর সর্বোচ্চ রূপ আমরা দেখতে পাই কারবালার প্রান্তরে। যখন ইমাম হুসাইন (আ.) তীব্রতম বিপদের মধ্যেও দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, اللَّهُمَّ رِضًا بِرِضَاك হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট।

আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রকৃত অর্থ
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন নাসের রাফিয়ি তাঁর এক বয়ানে বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি (رضایت خدا) তখনই অর্জিত হয়, যখন বান্দাও আল্লাহর প্রতিটি ফয়সালা ও পরিস্থিতির প্রতি রাযি থাকে। অর্থাৎ, সে মনে করে যে আল্লাহ যা করেছেন, তাতেই কল্যাণ নিহিত আছে।

মানুষের জীবনে কখনো কখনো সবকিছু তার ইচ্ছানুযায়ী চলে— আল্লাহ তাকে সন্তান দান করেন, সে খুশি হয়; ঘরবাড়ি ও সম্পদ দেন, সে কৃতজ্ঞ হয়; ভ্রমণের সুযোগ দেন, সে আনন্দিত হয়। কিন্তু যদি আল্লাহ সেই সন্তানকে কেড়ে নেন, তাহলে সেই মুহূর্তেও তার মনে অভিযোগ বা হতাশা আসা উচিত নয়।

যদি সম্পদ হারায়, কিংবা রোগ-ব্যাধি আসে, তবুও তার জিহ্বা যেন বলে— “আলহামদুলিল্লাহ ‘আলা কুল্লি হাল।” অর্থাৎ, সব অবস্থায়ই আল্লাহর প্রশংসা করি ও তাঁর সন্তুষ্টিই আমার জন্য যথেষ্ট।

এই অবস্থাই প্রকৃত রেজা বিল্লাহ— যেখানে বান্দা নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং বিশ্বাস রাখে যে, “আমার প্রতি যা নির্ধারিত, তাতেই আমার মঙ্গল।”

কুরআনের আলোকে আল্লাহর সন্তুষ্টি
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন: رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। [সূরা আল-মুজাদিলা, ৫৮:২২]

এই আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহর সন্তুষ্ট বান্দা সেই ব্যক্তি, যে সুখ ও দুঃখ উভয় অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, অভিযোগ করে না, বরং প্রতিটি ঘটনার মধ্যে প্রভুর হিকমত (দৈব প্রজ্ঞা) অনুধাবনের চেষ্টা করে।

আরেক স্থানে আল্লাহ তাআলা বলেন: يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ  ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর দিকে ফিরে এসো— তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, আর তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। [সূরা আল-ফজর, ৮৯:২৭–২৮]

এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আত্মার প্রশান্তি (নাফসে মুতমাইন্না) অর্জনের শর্তই হলো রেজায়েত বা সন্তুষ্টি— যেখানে মানুষ নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন করে দেয়।

রেওয়ায়াতের আলোকে রেজা বিল্লাহ
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন,
مَن رَضِيَ بِقَضاءِ اللّهِ عَلَيهِ، رَضِيَ اللّهُ بِهِ، وَمَن سَخِطَ عَلَى اللّهِ، سَخِطَ اللّهُ عَلَيهِ
যে ব্যক্তি আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে, আল্লাহও তার প্রতি সন্তুষ্ট হন; আর যে অসন্তুষ্ট হয়, আল্লাহও তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। [আল-কাফি, খণ্ড ২, হাদীস ৬১

ইমাম আলী (আ.) আরও বলেছেন, الرِّضا يَجمَعُ عِزَّ الدُّنيا و راحَةَ الآخِرَةِ রেজা বা সন্তুষ্টি দুনিয়ার মর্যাদা ও আখিরাতের প্রশান্তি একত্র করে দেয়।[গুরারুল হিকাম, হাদীস ৪৯১৬]

অর্থাৎ, আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ব্যক্তি পৃথিবীতেও সম্মানিত হয়, আর আখিরাতে শান্তি ও নিরাপত্তার আস্বাদ লাভ করে।

কারবালা: রেজা বিল্লাহর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনে আমরা রেজা বিল্লাহর চূড়ান্ত রূপ দেখি। কারবালার সেই ভয়াবহ দিনে তাঁর প্রতিটি প্রিয়জন একে একে শহিদ হন— ছয় মাস বয়সী শিশু আলী আসগর (আ.) তীরবিদ্ধ হয়ে শহিদ, ভাই আবুল ফজল আব্বাস (আ.) হাত হারালেন, আর সব সাহাবি রক্তে মিশে গেলেন।

তবুও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মুখে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। বরং তিনি শান্তচিত্তে বললেন,
إلهي رِضاً بِرِضاكَ، تَسليماً لأمرِكَ، لا مَعْبُودَ سِواكَ
হে আল্লাহ, আমি তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট, আত্মসমর্পণ করি তোমার আদেশে, তুমি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই।

এই বাণী কেবল ইমাম (আ.)-এর ব্যক্তিগত ধৈর্য নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও গভীর প্রেমের প্রতীক।

এখানেই বোঝা যায়, রেজা বিল্লাহ মানে নিস্তেজ আত্মসমর্পণ নয়, বরং সচেতনভাবে আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর আস্থা রাখা—এ বিশ্বাসে যে, যা-ই ঘটুক না কেন, তাতে তাঁর রহমত নিহিত আছে।

নৈতিক শিক্ষা ও উপসংহার
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কেবল বাহ্যিক সাফল্য বা সম্পদের প্রাচুর্যে নয়, বরং এটি হৃদয়ের প্রশান্তি, ধৈর্য এবং প্রভুর প্রতি অটল আস্থার ফল।

যে বান্দা সুখে-দুঃখে, অভাবে-সমৃদ্ধিতে আল্লাহর হুকুমে খুশি থাকে, সে-ই প্রকৃত মুমিন— যে কুরআনের ভাষায়
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ এর অন্তর্ভুক্ত।

অতএব, আসুন আমরা প্রত্যেকে আমাদের হৃদয়কে এমনভাবে গড়ে তুলি, যাতে আল্লাহর প্রতিটি সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকতে পারি। কারণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ কোনো বাহ্যিক সৌভাগ্যে নয়, বরং একটি সন্তুষ্ট ও আত্মসমর্পিত হৃদয় গঠনের মধ্যেই নিহিত।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha