হাওজা নিউজ এজেন্সি:* তিনি টেলিভিশন অনুষ্ঠান «আফতাবে শারকি»–তে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “ধৈর্যের প্রকৃত শিকড় তাওহিদভিত্তিক বিশ্বদৃষ্টিতেই নিহিত। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন: «وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ»,
অর্থাৎ—যখন মানুষের সম্পদ, জীবন কিংবা অর্জনে ঘাটতি আসে এবং সে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যে দুঃখ ও কষ্টের গভীরতা থেকেও নতুন এক বিকাশ ও উৎকর্ষের সূচনা করে।”
জনাবা আরদেবিলি বলেন, যারা বিপদের মুহূর্তে إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ উচ্চারণ করে, তারা এই মহাবিশ্বের চিরন্তন নিয়ম ও আল্লাহকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অনুভব করে। তারা জানে—মানুষ কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় ফিরে যাবে। এই জ্ঞান ও বিশ্বাসই ধৈর্যকে এক মহান অস্তিত্বগত গুণে পরিণত করে এবং মানুষকে আত্মিক পূর্ণতার পথে এগিয়ে নেয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “একজন ঈমানদার যখন উপলব্ধি করে যে গোটা জগৎ আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশের অধীনে এবং তাঁর অনুমতি ছাড়া একটি পাতাও ঝরে না, তখন তার অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যায়। অসুস্থতা, প্রিয়জনের মৃত্যু কিংবা জীবনের যেকোনো বিপর্যয়—এসবই আল্লাহর নির্ধারিত ব্যবস্থার অংশ। মানুষ যখন নিজেকে এই ঐশী পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত মনে করে, তখন উদ্বেগ, ভয় ও অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই মুছে যায়।”
নারী ও পরিবারবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “মানুষ যদি অনুভব করে যে সে বস্তুজগতের সীমা অতিক্রম করে এক উচ্চতর বাস্তবতার অধিবাসী, তবে জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতিতেও তার হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসে। ঘরে, পরিবারে, অসুস্থতা বা আর্থিক সংকটে—যে মানুষ জানে, আল্লাহ এই মুহূর্তেও তার প্রতিটি অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করছেন এবং তার প্রতিটি ধৈর্যের বিন্দু আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত হচ্ছে, সে উপলব্ধি করে প্রতিটি কঠিন মুহূর্ত আসলে তার আত্মিক উন্নতির একেকটি ধাপ।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ধৈর্য কেবল একটি আচরণ বা মানসিক অভ্যাস নয়; এটি এক পূর্ণাঙ্গ চিন্তাগত ও বিশ্বাসভিত্তিক ব্যবস্থা। যেমন একজন রোগী জানে—চিকিৎসকের অস্ত্রোপচার সাময়িকভাবে যন্ত্রণাদায়ক হলেও শেষ পর্যন্ত তা আরোগ্যের পথ খুলে দেয়; তেমনি একজন ঈমানদারও জানে, জীবনের প্রতিকূলতা, ক্ষতি ও দুঃখ আসলে তার আত্মাকে শুদ্ধ ও পরিপূর্ণ করার মাধ্যম।”
তিনি বলেন, “তাওহিদভিত্তিক দৃষ্টিতে ধৈর্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আল্লাহর প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন না হলে ধৈর্যের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা সম্ভব নয়। কুরআনে বহু স্থানে ধৈর্যকে নামাজের সঙ্গে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, নামাজের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক নবায়ন করে, অতীত ও পরকালীন গন্তব্যের কথা স্মরণ করে এবং এই ঈশ্বরিক সংযোগ থেকেই তার অন্তরে স্থিতি ও ধৈর্যের শক্তি জন্ম নেয়।”
তিনি একটি উদাহরণ টেনে বলেন, “যখন একজন মানুষ জানে যে সে কোনো শিক্ষক বা মহান ব্যক্তিত্বের সামনে রয়েছে, তখন সে নিজের আচরণ সংযত রাখে। একইভাবে, যদি মানুষ সত্যিই উপলব্ধি করে যে সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপস্থিতিতে অবস্থান করছে এবং ফেরেশতারা তার প্রতিটি কাজ ও প্রতিক্রিয়া লিখে রাখছে, তবে সে আরও ধৈর্যশীল, সংযমী ও প্রজ্ঞাবান আচরণ করবে। কারণ সে জানে—তার কোনো ধৈর্যের মুহূর্তই বৃথা যায় না।”
তিনি বলেন, “ধৈর্যের পথের শুরুটা হয়তো কঠিন ও ক্লান্তিকর মনে হতে পারে। অনেক সময় মানুষ মনে করে—তার ধৈর্য কেউ দেখছে না, তার পরিশ্রম বৃথা যাচ্ছে। কিন্তু যখন সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মুহূর্তে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং কোনো কষ্টই বিফল নয়, তখনই সেই জ্ঞান তার আত্মার বিকাশ ও আধ্যাত্মিক উন্নতির উৎস হয়ে ওঠে।”
তিনি শেষে উল্লেখ করেন, “আত্মিক পরিপূর্ণতা কখনো এক মুহূর্তে অর্জিত হয় না; এটি ধৈর্য, সাধনা, আত্মসংযম ও ধারাবাহিক প্রয়াসের ফল। মানুষের চিন্তাগত, আধ্যাত্মিক ও বিশ্বাসভিত্তিক কাঠামোই ধৈর্যকে জন্ম দেয়—আর ধৈর্যই পাল্টা সেই কাঠামোকে শক্তিশালী ও পরিণত করে। এই দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কই মানুষকে ক্রমে প্রশান্তি, প্রজ্ঞা ও চূড়ান্ত কৃতিত্বের দিকে নিয়ে যায়।”
আপনার কমেন্ট