হাওজা নিউজ এজেন্সি: এটি বলা অতিশয়োক্তি নয় যে ইমাম সাইয়্যেদ মুসা সাদর আধুনিক যুগে দক্ষিণ লেবাননে সমসাময়িক জিহাদের আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন, যার পরিণতিতে ২৪ মে ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন ইসরায়েলি দখল থেকে মুক্ত হয়। এই ঐতিহাসিক বিজয় ছিল লেবাননের ইসলামী ও জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের হাতে, যারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী— যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত সামরিক প্রযুক্তি-সজ্জিত ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল।
এ বক্তব্য কোনো অতিরঞ্জন নয়, কারণ লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের দুই প্রধান অঙ্গ—হিজবুল্লাহ এবং আমাল মুভমেন্ট—উভয়ই ইমাম মুসা সাদরকে তাদের জিহাদের আদর্শিক ও নৈতিক ভিত্তি হিসেবে দেখে।
আমরা “দক্ষিণ লেবাননের জিহাদ আন্দোলন”-কে সমসাময়িক বলেছি এ জন্য যে এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। দক্ষিণ লেবানের ইতিহাস—প্রাচীন ও আধুনিক উভয় সময়েই—প্রতিরোধ ও সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। এসব সংগ্রামে ধর্মীয় আলেমরা সবসময় অগ্রণী ও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন।
ইমাম মুসা সাদরের আন্দোলনের দ্বৈত লক্ষ্য
ইমাম মুসা সাদর তাঁর মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পর যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন, তা দুইটি পরস্পর-সম্পর্কিত মৌলিক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে—
১. সশস্ত্র প্রতিরোধ– জায়োনবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র, রাজনীতি ও গণমাধ্যম—সব কৌশল ব্যবহার করে লেবাননের ভূখণ্ডে তাদের অব্যাহত আগ্রাসন ও ভূমি অধিগ্রহণের লোভ মোকাবিলা করা।
১. সামাজিক ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন– লেবাননের প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম মানবিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় সেবা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তারা প্রতিদিনের জায়োনিস্ট হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সক্ষম হয়।
এই দুই লক্ষ্যের আলোকে ইমাম মুসা সাদর একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করেন এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “শিয়া ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল”, যার লক্ষ্য ছিল সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ২৩ মে ১৯৬৯ সালে তিনি পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল—
• জাতীয় ও আরব দায়িত্ব পালন,
• লেবাননের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা,
• অজ্ঞতা, পশ্চাদপদতা, সামাজিক বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই,
• ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে সমর্থন,
• এবং দখলকৃত ভূমি মুক্তিতে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
আমাল আন্দোলনের জন্ম
এই নীতিরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আমাল আন্দোলন (Harakat al-Amal)।
ইমাম মুসা সাদর ঘোষণা দেন— “এই মহান জাতীয় আন্দোলন মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় এবং ইসরায়েলকে সহজ আক্রমণের সুযোগ না দিতে তার সকল সদস্যের জীবন, সম্পদ ও সামর্থ্য উৎসর্গ করবে।”
তাঁর এই চিন্তাধারার ফলেই লেবাননে ধর্ম, বর্ণ ও জাতি সম্মিলনে একাধিক সমাজকল্যাণ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যা বাস্তবে প্রতিরোধ ও মানবসেবার ধারণাকে একত্র করে।
প্রতিরোধের ধর্মীয় দর্শন ও ইমাম মুসা সাদরের চিন্তাধারা
ইমাম মুসা সাদর সর্বদা প্রতিরোধকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ও ন্যায্য বলে দেখান। তাঁর মতে, প্রতিরোধকারীরা হলেন সেই মানুষ যারা মানবিক মূল্যবোধের রক্ষা করেন, নৈতিকতা বজায় রাখেন এবং আল্লাহ, মুহাম্মদ ও খ্রিষ্টের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন।
তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রতিরোধকারীদের অস্ত্র, ত্যাগ ও জিহাদ হলো ঐশ্বরীয় ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাতিয়ার, যা মানবজাতি ও ন্যায়বিচারের সেবায় প্রয়োগ করা হয়।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই: নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব
ইমাম মুসা সাদরের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল রাজনৈতিক সমস্যা নয়। এটি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব, যা ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের সীমা অতিক্রম করে। “এটি কোনো ব্যক্তিগত যুদ্ধ নয়, বরং বিশৃঙ্খলা, শোষণ, অন্যায় ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। প্রাচীন যুগের নবী আমাদের সতর্ক করেছেন—আমরা কি আজও সেই বিপদের মুখোমুখি হব না?”
ধর্ম তাঁর কাছে কেবল নামাজ, উপাসনা বা জন্মভূমি নয়; বরং এটি হলো স্থির সংকল্প, নৈতিক দৃঢ়তা ও কর্মমুখী বিশ্বাস।
জেরুজালেমের পুনঃমুক্তি: ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের সম্মিলিত লক্ষ্য
ইমাম সাদর জেরুজালেমকে মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয়ের পবিত্র কেন্দ্র বলে ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, “জেরুজালেম আমাদের কিবলা, আমাদের মূল্যবোধের মিলনস্থান এবং আমাদের ঐক্যের প্রতীক। এটি আমাদের দায় এবং এই মহান লক্ষ্য অর্জনের প্রতিরোধই আমাদের দায়িত্ব।”
তিনি ফিলিস্তিনের ফাতাহের নেতৃবৃন্দকে সতর্ক করেন, যাতে জেরুজালেমকে ইহুদি রাজনীতির অধীনে এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা হয়।
লেবাননের প্রতিরোধ সমাজ
ইমাম মুসা সাদর লেবানন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানান—
• সামরিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে,
• জনগণকে হস্তক্ষেপ এবং অস্ত্রধারী হতে প্রস্তুত করতে,
• আনুষঙ্গিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করতে,
• এবং সামরিক কনসক্রিপশন ও আধুনিক অস্ত্রাবলী প্রবর্তন করতে।
তিনি বোঝান যে, রাষ্ট্রের দুর্বলতা মূলত লেবাননের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তাই দক্ষিণ লেবাননকে যুদ্ধপূর্ণ সমাজে রূপান্তরিত করা অপরিহার্য, যাতে শত্রুর আগ্রাসন প্রতিরোধ করা যায়। “প্রতিটি যুবককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, অস্ত্র বহন করতে হবে এবং একটি লেবাননি প্রতিরোধ গঠন করতে হবে। আমাদের মধ্য থেকে অনেকের মৃত্যু হলেও, একজন বেঁচে থাকলেই সেটি বিজয়।”
ভবিষ্যতের পূর্বাভাস ও কৌশলগত দূরদর্শিতা
ইমাম সাদর ১৯৭৮ সালের ইসরায়েলি আক্রমণের এক সপ্তাহ আগে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং ঘোষণা করেন— “দক্ষিণ লেবাননের মুক্তি আমাদের দায়িত্ব। অন্য কোনও বাহিনী আমাদের জন্য এটি করবে না। বিশ্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেরাই দায়িত্ব গ্রহণ করব।”
তিনি জানতেন যে, দক্ষিণ লেবাননের প্রতিরোধ ভবিষ্যতে লেবানন ও আরব বিশ্বের জন্য নির্ধারণমূলক ভূমিকা পালন করবে।
দক্ষিণ লেবানন ও ফিলিস্তিন: অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
ইমাম মুসা সাদর দক্ষিণ লেবাননের পরিস্থিতিকে কেবল স্থানীয় সমস্যা মনে করেননি; বরং এটি ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বের জন্য নীতি নির্ধারণকারী বিষয়।
তিনি দাবী করেন, শক্তিশালী দক্ষিণ লেবানন জাতীয় প্রতিরোধের প্রথম প্রান্তর, যা লেবানন, আরব ও মানবাধিকারের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
তিনি দক্ষিণ লেবাননের জনগণকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে, সীমান্ত গ্রামগুলোকে দৃঢ়করণে সহায়তা করতে এবং রাষ্ট্রকে বাজেট ও সংস্থান বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে আহ্বান জানান।
ইমাম মুসা সাদরের প্রতিরোধ দর্শন কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মনে করতেন, লেবানন ও ফিলিস্তিনের মুক্তি নিশ্চিত করতে, জনগণকে সশস্ত্র ও সুসংগঠিত করা, সীমান্ত রক্ষা করা এবং সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
“প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষা কেবল দার্শনিক কথা নয়; এটি ধর্মীয় কর্তব্য, জাতিগত অধিকার এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা। আমাদের জীবন, রক্ত ও প্রচেষ্টা এই মহান লক্ষ্য অর্জনে উৎসর্গ করতে হবে।”
আপনার কমেন্ট