হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম খোমেনি (রহ.) বিশ্বাস করতেন—যে জাতি নিজের নেতৃত্ব ও নীতি ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সেই জাতিই প্রকৃত অর্থে মুক্ত ও মর্যাদাবান। ক্যাপিটুলেশন আইনের বিরুদ্ধে তাঁর বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ শুধু রাজনৈতিক প্রতিরোধ নয়; তা ছিল এক সভ্যতাগত বিদ্রোহ, যা ইরানকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে তাওহিদভিত্তিক রাষ্ট্র ও নতুন মানবিক সভ্যতার পথে পরিচালিত করেছে।
ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর দৃষ্টিতে স্বাধীনতা মানে কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়; এটি এক সভ্যতাগত পুনর্জাগরণ।
স্বাধীনতা অর্থ হলো—বিদেশি সভ্যতার প্রভাবমুক্ত হয়ে ঈমান, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে ঈশ্বরকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
ক্যাপিটুলেশন আইন: দাসত্বের চুক্তি, জাগরণের সূচনা
“আমেরিকান উপদেষ্টাদের রক্ষাকবচ আইন” বা ক্যাপিটুলেশন আইন ইরানের আধুনিক ইতিহাসের অন্ধকারতম, অথচ সবচেয়ে শিক্ষণীয় অধ্যায়গুলোর একটি। বাহ্যিকভাবে এটি ছিল একটি আইনি চুক্তি, কিন্তু বাস্তবে এটি ইরানের জাতীয় মর্যাদা, সভ্যতা ও সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ।
এই আইনই হয়ে ওঠে ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম প্রেরণার উৎস, যা শেষ পর্যন্ত ইরানি জাতির আত্মচেতনা ও স্বাধীনতার দাবিকে উজ্জীবিত করে।
পটভূমি: আমেরিকান আধিপত্য ও জাতীয় অবমাননা
১৯৫৩ সালের ২৮ আগস্ট আমেরিকা ও ব্রিটেনের যৌথ পরিকল্পনায় সংঘটিত অভ্যুত্থানের পর ইরানের রাজনীতি ও অর্থনীতি পুরোপুরি পশ্চিমা প্রভাবের অধীনে চলে যায়। ১৯৬০-এর দশকে প্রধানমন্ত্রী আলাম ও মনসুরের সরকারগুলো ছিল আমেরিকান স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৪ সালের ২১ অক্টোবর ইরানের সিনেট ক্যাপিটুলেশন আইন অনুমোদন করে, যার ফলে ইরানে নিযুক্ত আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তা ও উপদেষ্টারা ইরানি আদালতের বিচার থেকে অব্যাহতি পায়। এটি ছিল জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও বিচারিক স্বাধীনতার সরাসরি লঙ্ঘন।
পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্যের প্রকল্প
ক্যাপিটুলেশন শুধুমাত্র একটি আইনগত বিষয় ছিল না; এটি ছিল পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। এই ব্যবস্থায় আইনের উৎস, ন্যায়ের মানদণ্ড ও শাসনের বৈধতা আল্লাহ ও জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায়—আল্লাহকে শাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং জাতিকে সম্মান থেকে বঞ্চিত করা।
ইমাম খোমেনির জাগরণী হুঙ্কার (৪ নভেম্বর ১৯৬৪)
এই অপমানজনক আইনের বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনি (রহ.) কোমের ফায়জিয়া মাদ্রাসায় বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন— “আমি বিপদের ঘোষণা করছি! হে ইরানের সেনাবাহিনী! হে রাজনীতিবিদগণ! হে ইসলামের আলেমসমাজ!
আমাদের স্বাধীনতা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, আমাদের মর্যাদা পদদলিত হয়েছে! যদি কোনো আমেরিকান রাঁধুনি রাস্তায় তোমাদের মুজতাহিদকে হত্যা করে, তবুও ইরানের আদালত তাকে বিচার করতে পারবে না!”
তিনি নির্ভীক কণ্ঠে আরও বলেন— “আমি এই আইনকে জাতির দাসত্ব ঘোষণা করছি। আমাদের সরকার, সংসদ, ও সেনেট—সবাই এই জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”
এই ঐতিহাসিক ভাষণ ইরানের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও দাসত্বের সীমানা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেয়, এবং জাতির ধর্মীয় ও জাতীয় বিবেককে জাগিয়ে তোলে।
ফলাফল ও বিপ্লবের সূচনা
ইমাম খোমেনির এই ঘোষণায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। পাহলাভি শাসকগোষ্ঠী প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ১৯৬৪ সালের ১৩ নভেম্বর ইমামকে গ্রেফতার করে তুরস্কে নির্বাসিত করে। কিন্তু এই নির্বাসনই হয়ে ওঠে নতুন এক যুগের সূচনা, যা ১৯৭৯ সালের ২২ বাহমান বিপ্লবের মাধ্যমে বিজয়ে পরিণত হয়।
ক্যাপিটুলেশন থেকে বেলায়েতে ফকিহ পর্যন্ত
এই ঘটনার পর ইমাম খোমেনি উপলব্ধি করেন—জাতির দাসত্ব কেবল রাজনীতিতে নয়, বরং এর মূল নিহিত রয়েছে ঐশী শাসনব্যবস্থায়। তাই প্রকৃত মুক্তির একমাত্র পথ হলো স্রষ্টা নির্ভর শাসনব্যবস্থা—বেলায়েতে ফকিহ।
এই চিন্তাধারাই পরবর্তীতে জন্ম দেয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, যার মূলনীতি তিনটি শাশ্বত ধারণা— স্বাধীনতা, জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র।
বেলায়েতে ফকিহ: ঐশ্বরিক শাসনের ধারাবাহিকতা ও জাতীয় মর্যাদার নিশ্চয়তা
বেলায়েতে ফকিহ হলো ইমামতের ধারাবাহিক রূপ, যা খোদায়ী শাসনের রক্ষাকবচ ও জাতির মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
জাতীয় স্বাধীনতা এই নেতৃত্বের ফল, আর সভ্যতা নির্মাণের প্রকৌশল হলো এর বাস্তব প্রকাশ—যা তাওহিদ, ন্যায় ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
স্বাধীনতা: রাজনৈতিক স্লোগান নয়, সভ্যতার সত্য
ইমাম খোমেনি (রহ.) স্বাধীনতাকে রাজনীতির সীমাবদ্ধতা থেকে তুলে এনে সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্তরে উন্নীত করেছেন। তার দৃষ্টিতে প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই বাস্তব হয়, যখন আইন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিদেশি অনুকরণের বদলে ইসলামী ফিকহ ও ঈমানের উৎস থেকে সঞ্চারিত হয়।
স্বাধীনতার পর সভ্যতা নির্মাণের নতুন যুদ্ধ
ইসলামী বিপ্লবের বিজয় আমেরিকার শত্রুতা শেষ করেনি; বরং শুরু করেছে এক নতুন সভ্যতাগত সংঘর্ষ।
আজ যুদ্ধ আর বন্দুকের নয়; এটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, তথ্যযুদ্ধ, মানসিক প্রভাব ও ধর্মীয় বিকৃতির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। শত্রুর লক্ষ্য—ইরানকে আবারও নির্ভরশীল ও আত্মপরিচয়হীন জাতিতে পরিণত করা।
কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা, বেলায়েতে ফকিহের প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব, জনগণের ঈমান, ধৈর্য ও বাসিরাত (অন্তরদৃষ্টি) দিয়ে ইরানের জাতি এই ষড়যন্ত্রগুলোকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সুযোগে রূপান্তরিত করেছে।
সভ্যতা নির্মাণের পথনকশা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, বেলায়েতে ফকিহের নেতৃত্বে, এক নতুন সভ্যতা নির্মাণের পথে এগিয়ে চলছে। এই সভ্যতা নির্মাণের প্রকৌশল অন্তর্ভুক্ত করে—
• রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন ইসলামী শিক্ষার আলোকে
• বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠানিকীকরণ
• ঈমানদার, সংগ্রামী ও সভ্যতানির্মাতা মানুষ গঠন
• প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সক্ষমতা বৃদ্ধি
• বৈশ্বিক প্রতিরোধ ফ্রন্টকে শক্তিশালীকরণ ও নিপীড়িত জনগণের পক্ষে অবস্থান
বেলায়েতে ফকিহ—সভ্যতার দিকনির্দেশক কম্পাস
ক্যাপিটুলেশন ছিল জাতীয় মর্যাদার পতনের প্রতীক,
বেলায়েতে ফকিহ হলো সেই হীনতার প্রতিষেধক—জাতির আল্লাহপ্রদত্ত পরিচয়ের পুনর্জাগরণ, আর সভ্যতা নির্মাণের প্রকৌশল হলো ইসলামী বিপ্লবের অগ্রযাত্রার অব্যাহত দিশা।
এই তিনটি উপাদান—বেলায়েতে ফকিহ, জাতীয় স্বাধীনতা ও সভ্যতা নির্মাণ—প্রমাণ করে যে ইসলামী বিপ্লব কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি একটি তাওহিদি ও সভ্যতাগত রূপান্তর।
আজ, বেলায়েতে ফকিহের প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনা ও জনগণের ঈমানী দৃঢ়তার মাধ্যমে, ইরান এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতাগত স্বাধীনতা, ইসলামী পরিচয়ের পুনর্জন্ম এবং বিশ্বব্যাপী ন্যায় ও মর্যাদার বার্তা প্রচারের পথে।
ইমাম খোমেনির বাণী
যেমনটি মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেছেন— “যে ব্যক্তি জাতির মর্যাদা রক্ষা করে, সেই প্রকৃত জাতীয় স্বার্থরক্ষক।
যখন সে দেখে জাতির সম্মান পদদলিত হচ্ছে, তখন সে নীরব থাকে না—সে প্রতিবাদের আওয়াজ তোলে।” (বক্তব্য: জনগণ ক্বোমের সাথে সাক্ষাৎ, ১২ অবান ১৩৮৯)
“আর আল্লাহ কখনো অবিশ্বাসীদেরকে বিশ্বাসীদের ওপর কর্তৃত্ব দান করবেন না।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৪১)
আপনার কমেন্ট