রবিবার ৯ নভেম্বর ২০২৫ - ১১:১৮
সমাজের মানুষের জীবনধারার সংস্কার: আত্মিক স্বাস্থ্যের বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত

সমাজের মানুষের জীবনধারাকে "সকালাইন" (কুরআন ও আহলে বাইতের শিক্ষা) অনুযায়ী সংস্কার করা আত্মিক স্বাস্থ্যের বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, যাতে আমরা আল্লাহর বান্দাগিরির পথে “সুস্থ হৃদয়” (قلب سليم) নামক মহান গুণে পৌঁছাতে পারি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট  অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “জীবনধারা” বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এটি আত্মিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত—যেখানে উভয়ের পারস্পরিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আত্মিক স্বাস্থ্য মানে হলো জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য এবং নিজের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে এবং সর্বোচ্চ স্তরে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্কের অনুভূতি। আর জীবনধারার ধরন অনেকাংশে সমাজের আত্মিক স্বাস্থ্যের মান প্রকাশ করে।

জীবনধারার সংস্কারে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর গুরুত্ব

ড. মাহদি জামশিদি, ইসলামি সংস্কৃতি ও চিন্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, জীবনধারার সংস্কারের প্রয়াসে সাংস্কৃতিক বিষয়ে মনোযোগের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন: মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির নির্দেশনাগুলো—বিশেষত “বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ বিবৃতি”-তে—পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর দৃষ্টিতে সংস্কৃতির তিনটি প্রধান স্তর আছে:
একটি মানসিক বা দৃষ্টিভঙ্গিমূলক স্তর যা বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে;
একটি চরিত্রগত স্তর যা নৈতিকতা, স্বভাব ও গুণাবলি নিয়ে;
এবং তৃতীয়টি হলো বাহ্যিক স্তর, যা মানুষের আচরণ, কর্মকাণ্ড ও দৈনন্দিন জীবনে প্রকাশ পায়—এই তৃতীয় স্তরটিই ‘জীবনধারা’ নামে পরিচিত।

তিনি আরও বলেন: সংস্কৃতি যেহেতু পরিচয় নির্মাণ করে, সুতরাং সংস্কৃতির অংশবিশেষও পরিচয় নির্মাতা। জীবনধারাও সেই অর্থে পরিচয় গঠন করে। যদি জীবনধারা সংস্কৃতির একটি বিশেষ রূপ হয়, তাহলে বলা যায়, যেমন সংস্কৃতি কোনো সভ্যতার আত্মা, তেমনি জীবনধারাও সেই আত্মিক বৈশিষ্ট্য বহন করে।

জীবনধারা: অগ্রগতির তাত্ত্বিক ভিত্তির সফটওয়্যার স্তর

তিনি আরও বলেন: জীবনধারা আসলে অগ্রগতির তাত্ত্বিক কাঠামোর সফটওয়্যার দিক। তাই এটি সংস্কৃতির বাকি দুই স্তরের ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। ভুল জীবনধারা এমনকি মানুষের বিশ্বাসকেও বদলে দিতে পারে—অর্থাৎ আচরণ দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে। অনেক বিপ্লবী বিচ্যুতির কারণও এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়।

তিনি জোর দিয়ে বলেন: আত্মিক স্বাস্থ্যই জীবনধারার দিকনির্দেশক। যখন আমরা ইসলামি জীবনধারার কথা বলি, তখন আমরা ন্যূনতম ইসলামের কথা বলি না, বরং পূর্ণাঙ্গ ইসলামের, যা জীবনের সব ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং এক নতুন ধরণের সামাজিক কার্যকারিতা তৈরি করে। মহান নেতা কখনও কখনও “ইরানি জীবনধারা” কথাটিও ব্যবহার করেন। জাতীয় সংস্কৃতি আসলে সেই মূল্যবোধগুলোর সমষ্টি যা একটি জাতি-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়।

জীবনধারা ও আত্মিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক

ড. মাহদি আব্বাসজাদে, হাওজাহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বলেন: আত্মিকতানির্ভর জীবনধারা জীবনের চাপ ও দুর্যোগের বিরুদ্ধে অধিক সহনশীলতা এনে দেয়। জীবনধারা, আত্মিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা—এই তিনটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ইসলামি-ইরানি ধাঁচের সুস্থ জীবনধারা আত্মিক স্বাস্থ্যের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে।

তিনি আরও বলেন: জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্য দিয়েই জীবনধারার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়। ইসলামে মানুষের চার ধরণের সম্পর্ক ও দায়িত্ব আছে, যা ইমাম সাদিক (আ.)-এর নামে “মিসবাহুশ-শারিয়াহ ও মিফতাহুল-হাকিকাহ” গ্রন্থে বর্ণিত “উসুলুল-মু'আমালাত” হাদিসে উল্লেখ রয়েছে—
মানুষের সম্পর্ক:
১- আল্লাহর সঙ্গে,
২- নিজের সঙ্গে,
৩- অন্য মানুষের সঙ্গে,
৪- এবং বিশ্বের সঙ্গে।

ইসলামি জীবনধারার চর্চায় পৌঁছানো যায় প্রকৃত কল্যাণে

তিনি বলেন: ইসলামি জীবনধারায় মানুষের নিজের, অন্যদের ও বিশ্বের প্রতি দায়িত্বগুলো আল্লাহর প্রতি দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও তার অধীনস্থ। ফলে ইসলামি জীবনধারা জীবনের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত স্তরগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে।

তিনি যোগ করেন: ইসলামি জীবনধারার লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত কল্যাণ বা “সাআদাত”-এ পৌঁছানো, যা আল্লাহ, পরকাল ও ওহির শিক্ষায় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি তাওহিদনির্ভর, স্বভাবসুলভ ও সৃষ্টির নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক জীবনধারা। ইসলামি আত্মিকতা তাওহিদকেন্দ্রিক, সর্বাঙ্গীন, ধারাবাহিক ও লক্ষ্যনির্দেশিত। এটি মানবনির্মিত আধ্যাত্মিক দর্শনের মতো কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক দিককেও অন্তর্ভুক্ত করে।

ইসলামি আত্মিকতা: সমাজকেন্দ্রিক, নিঃসঙ্গতাবাদী নয়

তিনি বলেন: ইসলামি আত্মিকতা নিঃসঙ্গতাবাদী শিক্ষার বিপরীতে সমাজমুখী। এটি সমাজগঠন ও সভ্যতা নির্মাণের আহ্বান জানায়। এটি জুহদ বা asceticism (সংযম)-কে সমর্থন করে, কিন্তু ব্যক্তি-নির্ভর বা সমাজবিমুখ আধ্যাত্মিকতার থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। এটি একইসঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেয়। এমন আত্মিকতা সর্বদা বৃদ্ধি ও পরিশুদ্ধির পথে থাকে।

তিনি আরও বলেন: এই আত্মিকতায় জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি মানবীয় কর্মের সঙ্গে সমান্তরালে চলে; জ্ঞান ও কর্ম একে অপরকে সম্পূর্ণ করে। ইসলামি আত্মিকতা জীবনের কোনো বিচ্ছিন্ন অংশ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যবহারিক ব্যবস্থা, যার গভীরতা ও ব্যাপকতা অসাধারণ—এবং এটি আত্মিক স্বাস্থ্যের বাস্তবায়নের জন্য এক অনন্য কাঠামো।

“সুস্থ হৃদয় (قلب سليم)” — আত্মিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ সূচক

আব্বাসজাদে বলেন: কুরআনে এমন কিছু পরিভাষা আছে যা আত্মিক স্বাস্থ্যের ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, যেমন— “সুস্থ হৃদয় (قلب سلیم)”, “পবিত্র জীবন (حیات طیبه)”, “নিশ্চিন্ত আত্মা (نفس مطمئنه)” ইত্যাদি। এর মধ্যে “সুস্থ হৃদয়”-ই আত্মিক স্বাস্থ্যের ধারণার সবচেয়ে নিকটতর সমার্থক।
কুরআনভিত্তিক আত্মিক স্বাস্থ্যের প্রধান মানদণ্ডই হলো এই “সুস্থ হৃদয়” অর্জন। আর “পবিত্র জীবন” (حیات طیبه) হলো মানুষের পরম ও আদর্শিক গন্তব্য।

তিনি উপসংহারে বলেন: ইসলামি-ইরানি ধাঁচের সুস্থ জীবনধারা ইসলামী মূল্যবোধ ও ইরানের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ভিত্তি স্থাপন করে। ইসলামী নৈতিকতা, শৃঙ্খলা এবং সুস্থ সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এটি এক নিরাপদ ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনে সহায়তা করে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha