মঙ্গলবার ২৫ নভেম্বর ২০২৫ - ১৯:০৬
ফাতেমিয়া সম্পর্কে সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী পরিচয়ের পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি

ফাতেমিয়া সম্পর্কে সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী পরিচয়ের পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি

আফগানিস্তানের মুবাল্লিগদের জন্য হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. আলীজাদেহ মুসাভীর ফাতিমিয়া বিশেষায়িত কর্মশালা অনুষ্ঠিত

ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমের গাদীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে আফগানিস্তানি মুবাল্লিগদের জন্য আয়োজিত ফাতিমিয়া বিশেষায়িত কর্মশালা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কর্মশালাটি আফগানিস্তানি প্রতিনিধিনিত্ব পরিষদ এবং ইসলামী প্রচারণা দপ্তরের সাংস্কৃতিক ও প্রচারমূলক সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. আলীজাদেহ মুসাভী ফাতিমিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন, আপত্তি এবং ভুল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ড. আলীজাদেহ মুসাভী বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর ব্যক্তিত্বকে কেবল আবেগনির্ভর বা একমাত্রিকভাবে উপস্থাপন করা প্রচলিত ধারা একটি বড় ধরনের অবিচার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর সঠিক পরিচয় বোঝার জন্য তার ব্যক্তিত্বকে সভ্যতাভিত্তিক, মৌলিক এবং বিশ্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাঁর মতে, রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ইন্তেকালের পর নবগঠিত ইসলামী সভ্যতা চরম সংকটে পড়ে; সেই সংকট মোকাবেলায় হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) ইসলামী সভ্যতার মৌলিক উপাদানগুলো পুনঃসংজ্ঞায়িত ও শক্তিশালী করে তা রক্ষা করেছেন।

ফাতিমিয়া নিয়ে সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি: প্রচারণার বড় চ্যালেঞ্জ
ড. আলীজাদেহ মুসাভী ফাতিমিয়ার শাহাদাতের দিনগুলিতে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ফাতিমিয়া সম্পর্কে বিস্তৃত, সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। তিনি উল্লেখ করেন, অনেক সময় ফাতিমিয়াকে কেবল রাজনৈতিক বিতর্ক বা আবেগভিত্তিক শোকের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা হয়। ফাতিমিয়া একটি সভ্যতাভিত্তিক বিষয়, যা শাসন, নৈতিকতা, অর্থনীতি, নেতৃত্ব এবং শরীয়তের সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।

তিনি আরও বলেন, ফাতিমিয়া শুধুমাত্র ইতিহাস বা আবেগের বিষয় নয়, বরং ইসলামী সভ্যতার পতন ও পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি। হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর সুচিন্তিত নেতৃত্বই সেই সংকট মোকাবেলা করে ইসলামী সভ্যতাকে পুনর্জীবিত করেছেন।

ফাতিমিয়া: সভ্যতা গঠনের কেন্দ্রবিন্দু
ড. আলীজাদেহ মুসাভী সভ্যতাবিজ্ঞান তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর নেতৃত্বে ইসলামি সভ্যতা শাসন, ইমামতি, নৈতিকতা, অর্থনীতি, নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ এবং শরীয়ত পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখেছেন। তিনি খুতবা ফাদকিয়া–কে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়, বরং একটি সভ্যতাভিত্তিক সংবিধান, যা একত্রে তাওহীদ, নবুয়ত, শাসন ও অর্থনীতি পুনঃসংজ্ঞায়িত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষামূলক সভায় প্রচার করা উচিত।

ফাতিমিয়া সম্পর্কিত প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ
ড. আলীজাদেহ মুসাভী উল্লেখ করেন, যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, তখন সংশয়ও বৃদ্ধি পায়। শত্রুরা ফাতিমিয়ার সঠিক ব্যাখ্যা বুঝেছে এবং বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে। ফাতিমিয়া সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো মূলত তিন ভাগে বিভক্ত: ঐতিহাসিক, কালামি এবং আবেগভিত্তিক।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, মুবাল্লিগদের প্রথমে প্রশ্নগুলো শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে এবং তারপর যথাযথ উপকরণ ও পদ্ধতির মাধ্যমে উত্তর দিতে হবে। এছাড়া শ্রোতার মৌলিক চিন্তাভাবনার ভিত্তি তৈরি করা এবং ফাতিমিয়ার সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

ড. আলীজাদেহ মুসাভী সুন্নি উৎস যেমন মুসনাদে আহমাদ বিন হান্বাল, সহীহ বুখারি, সুনানে নাসাঈ–এর উদাহরণ দিয়ে বলেন, এসব উৎসে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর অবস্থান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত বহু হাদিস আছে, যা প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আলোচনার অংশ হিসেবে তিনি অধ্যয়ন-উপযোগী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসও সুপারিশ করেন, যেমন—

• আয়াতুল্লাহ নাজমুদ্দিন তাবাসির «پاسخ به چند شبهه فاطمی» (ফাতেমিয়া-সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর),

• হাওজায়ে ইলমিয়া কোমের ‘দফ ও রাফ’ গবেষণা-বই,

• এবং «مرجعیت علمی حضرت زهرا» সিরিজের গবেষণাধর্মী ভিডিওসমূহ।

মুবাল্লিগদের ভূমিকা
ড. আলীজাদেহ মুসাভী মুবাল্লিগদের ওপর গুরুত্বারোপ করেন যে, তারা হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–কে সভ্যতা গঠনের মডেল হিসেবে পরিচয় করান। তিনি কেবল একজন ধর্মীয় ব্যক্তি নয়, বরং একজন সভ্যতা পরিচালক, যিনি সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়ে ইসলামী সভ্যতাকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হন।

তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে কিছু তালেবান নেতৃবৃন্দ এবং চিন্তাবিদদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফাতিমিয়ার সভ্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করেছেন এবং বলেন, এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার করা প্রয়োজন।

অংশগ্রহণকারীরা কর্মশালার ইলমি গভীরতা, বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনা এবং ব্যবহারিক নির্দেশনার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা এটিকে সাম্প্রতিক বছরের অন্যতম সমৃদ্ধ ও প্রয়োজনীয় আয়োজন হিসেবে অভিহিত করেছেন। আশা করা হচ্ছে, কর্মশালার প্রাপ্ত জ্ঞান আগামীর ফাতিমিয়া অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নে, বিশেষত আফগান শরণার্থী সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ফারসিভাষী শ্রোতার মধ্যে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha