বৃহস্পতিবার ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৫:৩৮
হজরত ফাতিমা (সা.আ.): আদর্শ নৈতিকতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি

হজরত ফাতিমা (সা.আ.)—নবী পরিবারের পবিত্র আলোকধারা, যাঁর জীবন ছিল নৈতিকতা, বিনয় ও মানবিকতার এক অনন্য বিদ্যালয়। তাঁর চরিত্রে সমবেত হয়েছিল পবিত্রতার সর্বোচ্চ নিদর্শন এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের গভীরতম শিক্ষা, যা আজও মানবতার পথচলায় দিশারী হয়ে আছে।

হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর পবিত্র বেলাদাত দিবস উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের আলেম হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মাকবুল হাসান (মোবাল্লিগ ও গবেষক) একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরছি: 


হাওজা নিউজ এজেন্সি:
আসসালামু ওয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, মাকবুল হাসান সাহেব, আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য। আজকের আলোচ্য বিষয়—হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর নৈতিক আদর্শ। প্রথমেই জানতে চাই, কেন তাঁকে “আদর্শ নৈতিকতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি” বলা হয়?

মাকবুল হাসান: ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আপনাকেও ধন্যবাদ। আসলে হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর ব্যক্তিত্ব মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের একটি পূর্ণাঙ্গ নমুনা। সত্যবাদিতা, বিনয়, দানশীলতা, ধৈর্য, আত্মসম্মান, পরোপকার—প্রতিটি গুণ তাঁর জীবনে বাস্তবভাবে দেখা যায়। তিনি নৈতিকতার এমন এক উচ্চ আসনে অবস্থান করেন, যেখানে তাঁর প্রতিটি আচরণ মানুষকে শিক্ষা দেয় কীভাবে আদর্শ চরিত্র গঠন করতে হয়। তাই তাঁকে “নৈতিকতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি” বলা খুবই স্বাভাবিক।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর নৈতিকতার কোন দিকটি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক বলে আপনি মনে করেন?

মাকবুল হাসান:

সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক দিক হলো তাঁর আত্মমর্যাদা ও বিনয়ের অনন্য সমন্বয়।
তিনি ছিলেন বিশ্বনবীর (সা.) কন্যা, কিন্তু তাঁর আচরণে ছিল অসাধারণ সরলতা। সমাজের নিঃস্বদের সঙ্গে তিনি যে সম্মান ও ভালোবাসা দেখাতেন, তা আজও আমাদের লজ্জা দেয়। একইসাথে অন্যায়ের সামনে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও সাহসী। এই দুটো গুণ—বিনয় ও দৃঢ়তা—একসাথে ধারণ করা সত্যিই অসাধারণ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

আপনি একজন মোবাল্লিগ ও গবেষক হিসেবে তাঁর নৈতিক শিক্ষাকে কীভাবে আধুনিক সমাজে প্রয়োগযোগ্য মনে করেন?

মাকবুল হাসান:

তাঁর নৈতিক শিক্ষা সময়-সীমাহীন। আধুনিক সমাজে এগুলোর প্রয়োগ দেখতে পাই তিনটি ক্ষেত্রে—

১. পারিবারিক জীবন:

সম্মান, সহনশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা তিনি বাস্তব জীবনে দেখিয়েছেন।

আজকের পরিবারগুলোতে যে ভুল বোঝাবুঝি ও সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা যায়, তাঁর জীবন সেখানে শান্তির পথ দেখায়।

২. সামাজিক ন্যায়বিচার:

তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন।

আজকের সমাজে দুর্নীতি, বৈষম্য ও অন্যায়ের মোকাবিলায় তাঁর সাহসিকতা আমাদের পথ দেখায়।

৩. ব্যক্তিগত চরিত্র উন্নয়ন:

বিনয়, ধৈর্য, সত্যবাদিতা, পরোপকার—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক গুণ।

বর্তমান যুগের ভোগবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে এই গুণগুলোই মানুষের চরিত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবনকে অনেক সময় আদর্শ নারীত্বের সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আপনি এর যুক্তি কীভাবে দেখেন?

মাকবুল হাসান:

এটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সত্য। তিনি ছিলেন—

একজন আদর্শ কন্যা,

স্নেহময়ী স্ত্রী,

শিক্ষাদায়ক মা,

সমাজসচেতন নারী,

এবং নীতিনিষ্ঠ একজন মানবিক নেতা।

আজকের নারীরা যেসব ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চান—শিক্ষা, ক্যারিয়ার, পরিবার, সমাজসেবা—ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রে এক সৌন্দর্যমণ্ডিত দিকনির্দেশনা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর নৈতিকতার সাথে ইবাদত বা আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মাকবুল হাসান:

তাঁর নৈতিকতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আধ্যাত্মিকতা।
যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান রাখে, সে স্বভাবতই সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার প্রতি অটুট হয়।
ফাতিমা (সা.আ.)-এর ইবাদত ছিল শুধু আচার নয়—এটা ছিল অন্তরের পবিত্রতা ও অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগানোর প্রক্রিয়া।
তাই তাঁর নৈতিকতা ছিল ইবাদতের বাস্তব রূপ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

আজকের যুবসমাজ নৈতিক সংকটে ভুগছে। তাদের জন্য ফাতিমা (সা.আ.) কী ধরনের আদর্শ হতে পারেন?

মাকবুল হাসান:

যুবসমাজের জন্য তিনি তিনভাবে আদর্শ—

১. স্বচ্ছ চরিত্র:
তিনি শেখান—চরিত্রই মানুষের প্রকৃত পরিচয়।

২. মিশন-ভিত্তিক জীবন:
নিজের মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার থাকা জরুরি।

৩. সাহসিকতা:
সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা।

আজকের তরুণদের জন্য এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ তারা নানা বিভ্রান্তি, প্রতিযোগিতা ও চাপের মধ্যে থাকে। ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবন তাদের স্থিরতা ও দিকনির্দেশনা দিতে পারে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

অনেকে মনে করেন, নৈতিকতা শুধু আদর্শিক কথা। বাস্তবে কি এটি জীবন পরিবর্তন করতে পারে?

মাকবুল হাসান:

অবশ্যই পারে। নৈতিকতা হলো মানুষের চিন্তা, সিদ্ধান্ত ও আচরণের ভিত্তি।
যদি কোনো পরিবারে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানেই শান্তি আসে।
যদি সমাজে নৈতিকতা প্রয়োগ হয়, অন্যায় কমে।
আর যদি ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিকতা থাকে, মানুষ ভুল পথ থেকে দূরে থাকে।
ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবন প্রমাণ করে—নৈতিকতা শুধু আলোচনার বিষয় নয়; এটি জীবন বদলে দিতে পারে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

এই আলোচনার শেষে আমাদের পাঠকদের জন্য আপনি কী বার্তা দিতে চান?

মাকবুল হাসান:

আমার বার্তা খুবই সহজ—
ফাতিমা (সা.আ.)-এর নৈতিকতা শুধু ধর্মীয় আদর্শ নয়; এটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের পথ।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—

ভালোবাসা মানবতার ভিত্তি,

সত্য নৈতিকতার ভিত্তি,

আর ধৈর্য সাফল্যের ভিত্তি।

আমরা যদি তাঁর নৈতিকতাকে জীবনে ধারণ করতে পারি, তাহলে পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তি—সব ক্ষেত্রেই আলো ছড়াবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

মাকবুল হাসান সাহেব, অসাধারণ বিশ্লেষণ ও মূল্যবান বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। সত্যিই হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর নৈতিক আদর্শ আমাদের সকলের জন্য জীবন্ত পথনির্দেশনা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha