শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১০:৪০
জন্মদিবস উপলক্ষে ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা পুনরাবিষ্কার

হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস শুধু একটি পবিত্র স্মরণ দিবস নয়, বরং তাঁর জীবনদর্শন ও অনন্য শিক্ষাকে নতুন করে উপলব্ধি করার আমন্ত্রণ। নৈতিকতা, ন্যায়, মানবিকতা ও পরিবারজীবনে তাঁর দৃষ্টান্তসমূহ আজও আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে দিশা দেখায়। তাই এই বিশেষ দিনে তাঁর চিন্তা ও আদর্শ পুনরাবিষ্কার আমাদের আত্মিক ও নৈতিক জাগরণের পথকে আরও আলোকিত করতে পারে।

জন্মদিবস উপলক্ষে ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা পুনরাবিষ্কার উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের আলেম হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন জয়নুল আবেদীন (আন্তর্জাতিক মোবাল্লিগ ও গবেষক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত) একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরছি: 

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

আসসালামু ওয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন জয়নুল আবেদীন সাহেব, আপনাকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজ আলোচনা করব ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস ও তাঁর শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। প্রথমেই জানতে চাই—ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবসকে শিক্ষা পুনরাবিষ্কারের উপলক্ষ হিসেবে দেখার ভিত্তি কী?

জয়নুল আবেদীন:

ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ধন্যবাদ। ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মরণ নয়; এটি মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার নবজাগরণ। তাঁর ছোট্ট জীবনে যে পরিমাণ জ্ঞান, দর্শন ও চরিত্রের শিক্ষা নিহিত আছে, তা বিশ্বমানবতার জন্য এক অনন্য সম্পদ। তাই তাঁর জন্মদিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা তাঁর আদর্শকে কতটা ধারণ করছি এবং কোথায় পুনরাবিষ্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা সাধারণ মানুষের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?

জয়নুল আবেদীন:

তাঁর শিক্ষা মূলত চারটি দিককে স্পর্শ করে—

১. নৈতিকতা: সত্যবাদিতা, বিনয়, পরোপকার।

২. পারিবারিক দায়িত্ব: একজন আদর্শ কন্যা, স্ত্রী ও মা হিসেবে তাঁর আচরণ আজও পথনির্দেশক।

৩. সামাজিক সচেতনতা: তিনি শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সমাজের অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্যও কণ্ঠ তুলেছিলেন।

৪. আধ্যাত্মিকতা: আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান, ইবাদতে নিবেদন ও পরিমিত জীবনযাপন।

এই শিক্ষা ব্যক্তির চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে এবং সমাজকে শান্তি, ন্যায় ও সৌহার্দ্যের দিকে পরিচালিত করে।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

আপনার মতে, বর্তমান সময়ে “ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা পুনরাবিষ্কার” কেন এত জরুরি?

জয়নুল আবেদীন:

আজকের বিশ্ব ভোগবাদ, বৈষম্য, পারিবারিক ভাঙন ও মানসিক অশান্তিতে ভরপুর। মানুষ বাহ্যিক উন্নয়নে যত অগ্রসর হচ্ছে, অন্তর তত শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা আমাদের শেখায়—

অন্তরের পরিশুদ্ধতা,

পরিবারে সৌহার্দ্য,

সমাজে ন্যায়বিচার,

এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা।

এই গুণগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারলে আধুনিক সমাজের অনেক সংকটই দূর হতে পারে। তাঁর শিক্ষা যেন “আত্মার চিকিৎসা”।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

কিছু মানুষ মনে করেন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের শিক্ষা শুধু অতীতের জন্য। বর্তমানের জন্য তা কতটা প্রযোজ্য?

জয়নুল আবেদীন:

এটি একটি ভুল ধারণা। আল্লাহর প্রতিনিধিদের জীবন ও তাদের শিক্ষাই চিরকালীন। ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষা সময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়।
উদাহরণ হিসেবে—

কর্মজীবী নারীদের জন্য তাঁর পরিশ্রম ও মর্যাদাবোধ,

তরুণদের জন্য তাঁর চরিত্র দৃঢ়তা,

অভিভাবকদের জন্য তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি,

এবং সমাজকর্মীদের জন্য তাঁর ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম—
সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক।
তিনি ছিলেন এমন এক মডেল, যিনি ধর্ম ও বাস্তবতার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করেছেন।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

জয়নুল আবেদীন সাহেব, আপনি একজন আন্তর্জাতিক মোবাল্লিগ। দাওয়াত বা প্রচারের ক্ষেত্রে ফাতিমা (সা.আ.)-এর শিক্ষাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

জয়নুল আবেদীন:

প্রচারের মূল নীতি হলো চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত করা—যা ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবনের বড় শিক্ষা।
আমি তিনভাবে তাঁর শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করি

১. কথার আগে চরিত্র: তিনি প্রমাণ করেছেন যে মানুষের হৃদয় জয় হয় আচরণ দিয়ে।

২. মমতা ও নম্রতা: দাওয়াতের ভাষা কখনো কঠোর বা বিতর্কমূলক হওয়া উচিত নয়।

৩. সহানুভূতি ও সহমর্মিতা: তিনি নিঃস্ব মানুষদের সাহায্য করতেন এমনভাবে যে কেউ অপমানিত বোধ করত না।
পৃথিবীর যে কোনো সংস্কৃতিতে এই গুণগুলো মানুষকে আকৃষ্ট করে।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবসকে কেন্দ্র করে আজকের তরুণ প্রজন্ম কোন কোন শিক্ষাকে বিশেষভাবে গ্রহণ করা উচিত?

জয়নুল আবেদীন:

তরুণদের জন্য পাঁচটি শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—

১. জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ।

২. পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা।

৩. নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি সম্মানবোধ।

৪. সাহসিকতা—সঠিকের পক্ষে দাঁড়ানো।

৫. সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা।

তরুণরা যদি এই শিক্ষাগুলো ধারণ করে, তারা হবে আত্মবিশ্বাসী, সচেতন এবং সমাজের পরিবর্তনকারী শক্তি।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

আমরা দেখি অনেক সময় মানুষ শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মদিবস পালন করে। কিন্তু বাস্তব পরিবর্তনে তা কাজে লাগে না। আপনি কীভাবে দেখেন?

জয়নুল আবেদীন:

এটি সত্য। জন্মদিবস পালনের উদ্দেশ্য শুধু উৎসব নয়; বরং সেই মহান ব্যক্তিত্বের আদর্শকে জীবনে ধারণ করা।
ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস আমাদেরকে তিনটি প্রশ্ন করতে শেখায়—

আমি কি সত্যিই তাঁর শিক্ষার আলোকে জীবন গড়ছি?

আমি কি পরিবারে শান্তির উৎস?

আমি কি সমাজে ন্যায় ও মানবিকতার জন্য অবদান রাখছি?

যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ইতিবাচক হয়, তবেই তাঁর জন্মদিন উদযাপন অর্থবহ হবে।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

শেষ প্রশ্ন—ফাতিমা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষে আপনি আমাদের শ্রোতাদের জন্য কী বার্তা দিতে চান?

জয়নুল আবেদীন:

আমার বার্তা হলো—ফাতিমা (সা.আ.) কেবল একটি ঐতিহাসিক চরিত্র নন; তিনি এক চিরন্তন আদর্শ।
তার জন্মদিনে চলুন আমরা—

সত্যকে ধারণ করি,

নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দিই,

পরিবারে ভালোবাসা ছড়াই,

সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখি।

এই পথেই আমরা তাঁর শিক্ষাকে পুনরাবিষ্কার করতে পারব এবং নিজেদের জীবনকেও আলোকিত করতে পারব।

হাইজা নিউজ এজেন্সি:

ধন্যবাদ জয়নুল আবেদীন সাহেব। আপনার গভীর বিশ্লেষণ ও মূল্যবান বক্তব্য আমাদের নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করেছে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha