হাওজা নিউজ এজেন্সি: হাদীসে শরীফে এসেছে যে, যে কেউ ইস্তেগফারের নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তার সমস্ত জীবন ব্যবস্থা নিজ হাতে ঠিক করে দেবেন।
«یصلح الله لک شأنک کله»
"আল্লাহ নিজ মহা প্রতাপ ও শক্তি দিয়ে তোমার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিবেন।" (মাকারিমুল আখলাক)
ইস্তেগফার নামাজের পদ্ধতি
এই নামাজ দুই রাকাতের হয়ে থাকে। প্রতিটি রাকাতে নিম্নলিখিতভাবে নামাজ আদায় করতে হবে:
১. প্রথমে সুরা ফাতিহা (الحمد لله) পাঠ করতে হবে।
২. তারপর সুরা কদর (إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ) তিলাওয়াত করতে হবে।
৩. এরপর ১৫ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" (আস্তাগফিরুল্লাহ) পড়তে হবে।
৪. রুকুতে গিয়ে "سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ وَبِحَمْدِهِ" (সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম ওয়া বিহামদিহি) বলার পর ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
৫. রুকু থেকে উঠে পুনরায় ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" বলতে হবে।
৬. প্রথম সেজদায় গিয়ে "سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى وَبِحَمْدِهِ" (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা ওয়া বিহামদিহি) বলার পর ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
৭. দুই সেজদার মাঝখানে বসে ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
৮. দ্বিতীয় সেজদায় গিয়ে আবার "سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى وَبِحَمْدِهِ" বলার পর ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
৯. দ্বিতীয় সেজদা থেকে ওঠার পর আবার ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
দ্বিতীয় রাকাতেও একইভাবে নামাজ আদায় করতে হবে এবং শেষে তাশাহহুদ ও সালাম দিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে।
নোট:
শুধুমাত্র "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" বলা যথেষ্ট।
"ربي وأتوب إليه" যুক্ত করার প্রয়োজন নেই
কিছু সূত্রে বলা হয়েছে, এই নামাজ জাফর তায়্যারের নামাজের মতো শেষ করা উত্তম। তবে বেশিরভাগ উৎসে সাধারণ পদ্ধতিতে নামাজ শেষ করার কথাই বলা হয়েছে।
ইস্তেগফার নামাজের সময়
আয়াতুল্লাহ বাহজাত (রহ.) ইস্তেগফার করার সর্বোত্তম সময় হিসেবে সেহরির মুহূর্তকে, বিশেষ করে শুক্রবারের শেষ রাতকে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি প্রতিদিন সেহরির সময় ইস্তেগফারের নামাজ পড়তেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
«إِذا رَأَیْتَ فى مَعاشِکَ ضیقاً وَ فى أَمْرِکَ إِلْتِیَاثاً فَأَنْزِلْ حاجَتَکَ بِاللهِ تَعالى وَ جَلَّ ، وَلاتَدَعْ صَلاهَ الإِسْتِغْفارِ …»
(অর্থ) যখন তোমার জীবিকা সংকুচিত হয়ে যায় এবং তোমার কাজ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে, তখন তোমার প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নিবেদন কর এবং ইস্তেগফারের নামাজ ত্যাগ করো না।
ইস্তেগফারের নামাজের দলিল
ইস্তেগফার নামাজ মহানবী (সা.)-এর একটি মূল্যবান উপহার, যা তিনি মুসলমানদের সংকট ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন।
عَنِ اَلنَّبِیِّ صَلَّى اَللَّهُ أَنَّهُ قَالَ:
"إِذَا رَأَیْتَ فِی مَعَاشِکَ ضِیقاً وَ فِی أَمْرِکَ اِلْتِیَاثاً فَأَنْزِلْ حَاجَتَکَ بِاللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ وَ لاَ تَدَعْ صَلاَهَ اَلاِسْتِغْفَارِ وَ هِیَ رَکْعَتَانِ تَفْتَتِحُ اَلصَّلاَهَ وَ تَقْرَأُ اَلْحَمْدَ وَ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ مَرَّهً وَاحِدَهً فِی کُلِّ رَکْعَهٍ ثُمَّ تَقُولُ بَعْدَ اَلْقِرَاءَهِ أَسْتَغْفِرُ اَللَّهَ خَمْسَ عَشْرَهَ مَرَّهً ثُمَّ تَرْکَعُ فَتَقُولُهَا عَشْراً عَلَى هَیْئَهِ صَلاَهِ جَعْفَرٍ رَضِیَ اَللَّهُ عَنْهُ یُصْلِحُ اَللَّهُ لَکَ شَأْنَکَ کُلَّهُ."
নবী (সা.) বলেছেন: যদি তোমার জীবিকা সংকুচিত হয়ে যায় এবং তোমার কাজ বিশৃঙ্খলায় পড়ে, তাহলে তোমার প্রয়োজন আল্লাহর দরবারে নিবেদন কর এবং ইস্তেগফার নামাজ ত্যাগ করো না।
এই নামাজ দুই রাকাত। প্রতিটি রাকাতে:
সুরা ফাতিহা এবং সুরা কদর তিলাওয়াত করতে হবে।
এরপর ১৫ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
রুকুতে গিয়ে ১০ বার,
রুকু থেকে উঠে ১০ বার,
প্রথম সেজদায় ১০ বার,
দুই সেজদার মাঝখানে ১০ বার,
দ্বিতীয় সেজদায় ১০ বার,
দ্বিতীয় সেজদা থেকে ওঠার পর ১০ বার "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" পড়তে হবে।
নামাজের সমাপ্তি:
এই নামায সাধারণ পদ্ধতিতে শেষ করলেই হবে৷ এটি এমন একটি নামাজ যা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যখনই প্রয়োজন অনুভব করবেন, তখনই এটি আদায় করতে পারবেন।
হাদীসে ইস্তেগফারের গুরুত্ব
একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি ইমাম রেযা (আলাইহিস সালাম)-এর কাছে এসে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অভিযোগ করলেন। ইমাম (আ.) তাকে ইস্তেগফার (অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা) করতে বললেন।
এরপর আরেকজন ব্যক্তি এসে দারিদ্র্য ও অর্থকষ্টের অভিযোগ করলেন। ইমাম (আ.) তাকে ইস্তেগফার করতে বললেন।
এরপর আরেক ব্যক্তি এসে ইমামের কাছে সন্তান লাভের জন্য দোয়া করতে অনুরোধ করলেন। ইমাম (আ.) তাকেও ইস্তেগফার করতে বললেন।
ইমামের এই একই পরামর্শ দেখে উপস্থিত ব্যক্তিরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন: তিনজন ব্যক্তি তিনটি ভিন্ন সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলেন, কিন্তু আপনি প্রত্যেককে একই পরামর্শ (ইস্তেগফার) দিলেন?
তখন ইমাম রেযা (আ.) বললেন: আমি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলিনি, বরং আমি আল্লাহর কালামের অনুসরণ করেছি। এরপর তিনি সুরা নূহের ১০-১২তম আয়াত তিলাওয়াত করলেন:
«فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّکُمْ إِنَّهُ کَانَ غَفَّارًا یُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَیْکُمْ مِدْرَارًا وَیُمْدِدْکُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِینَ وَیَجْعَلْ لَکُمْ جَنَّاتٍ وَیَجْعَلْ لَکُمْ أَنْهَارًا»
"তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এবং তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য উদ্যানসমূহ ও প্রবাহিত নদীসমূহ সৃষ্টি করবেন।"
উপদেশ:
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, ইস্তেগফার কেবলমাত্র পাপ মোচনের মাধ্যমই নয়, বরং এটি জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, দারিদ্র্যের নিরাময়, বরকতের কারণ এবং সন্তান লাভের উপায় হিসেবেও কার্যকর। তাই প্রতিদিন বেশি বেশি "أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ" বলা আমাদের জন্য কল্যাণকর।
ইস্তেগফার নামাজের বরকত ও অলৌকিক ফজিলত
যেমনটি বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নামাজকে অত্যন্ত কল্যাণকর ও পূর্ণ ফজিলতপূর্ণ মনে করতেন। তিনি বলেছেন:
"যখন জীবন কঠিন হয়ে পড়ে, সমস্যায় পড়ে যাও, তখন কখনোই ইস্তেগফারের নামাজ পরিত্যাগ করো না। বরং আল্লাহর দরবারে তোমার প্রয়োজন তুলে ধরো, তাহলে তিনি তোমার সব কাজ সহজ করে দেবেন এবং তোমাকে সংকট ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবেন।"
ইমাম বাকির (আ.)-এর উপদেশ
ইসমাঈল ইবনে সুহাইল বলেন:
"আমি ইমাম বাকির (আ.)-এর কাছে একটি চিঠি লিখে জানালাম যে, আমি অত্যন্ত বড় ঋণের মধ্যে পড়ে গেছি। এই ঋণ আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে এবং আমার মান-সম্মানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ইমাম বাকির (আ.) আমাকে উত্তরে লিখলেন:
«أَکْثِرْ مِنَ الإِسْتِغْفارِ وَ رَطِّبْ لِسانکَ بِقَراءَهِ «إِنّا أَنْزَلْناهُ»»
(অর্থ): "বেশি বেশি ইস্তেগফার করো এবং তোমার জিহ্বাকে সুরা কদর (إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ) এর তিলাওয়াতে সতেজ রাখো।"
আমি তাঁর এই পরামর্শ মেনে চললাম, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আমার ঋণের সমস্যা সমাধান হয়ে গেল।
ইস্তেগফার নামাজের অলৌকিক প্রভাব
হাদিসে এসেছে যে, যে কেউ ইস্তেগফারের নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তার সমস্ত জীবন ব্যবস্থা নিজ হাতে ঠিক করে দেবেন।
«یصلح الله لک شأنک کله»
(অর্থ): "আল্লাহ নিজ মহা কুদরতী ও শক্তি দিয়ে তোমার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবেন।"
দারিদ্র্য দূর করা ও জীবিকা বৃদ্ধি
ইস্তেগফারের নামাজ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস ও ঘটনাবলি পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে যে-
★ এটি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়,
★ ঋণ পরিশোধের উপায়,
★ জীবিকা বৃদ্ধি ও বিত্তশালী হওয়ার মাধ্যম।
গ্রন্থসূত্র:
- মাফাতিহুল জিনান – শেখ আব্বাস কুম্মী
- মাকারিমুল আখলাক – হাসান ইবনে ফযল তাবারসী, পৃষ্ঠা ৩২৮
লেখা: নাজমুল হক (কোম, ইরান)
আপনার কমেন্ট