হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২২ বাহমান ১৩৫৭ (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। এই বিপ্লবে ধর্মীয় নেতাদের (মারাজে তাকলিদ) ও আলেমদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই, এই আলোচনায় আমরা পহলভি রাজবংশের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের ভূমিকা বিশ্লেষণ করব।
সংগ্রামের কেন্দ্রীকরণ ও নেতৃত্বের সন্ধান
ধর্মীয় আলেমদের সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ছিল আন্দোলনকে একটি কেন্দ্রীভূত ও সুসংগঠিত রূপ দেওয়া। এর জন্য একটি অভিন্ন নেতৃত্ব ও স্পষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল। কিন্তু এই পথে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল, যা অতিক্রম করাও একপ্রকার ভিন্নধর্মী লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছিল।
আলেমদের সফলতার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁদের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি ও এই প্রস্তুতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। বিপ্লবপন্থী আলেমদের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সমাজের ধর্মপ্রাণ জনগণের কাছে তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানো। এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ম ও রাষ্ট্র পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল। পাশাপাশি, বিপ্লববিরোধী আলেমদের বিরোধিতার মুখেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা তাঁদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত কাজ ছিল। তবে, এই বিরোধিতা যেন বিভেদ সৃষ্টি না করে, সে বিষয়েও তাঁরা সচেতন ছিলেন, কারণ বিভাজন পুরো আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে পারত।
রাজনৈতিক সংগ্রামের বাস্তবায়ন
আলেমরা রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন এমন একটি বিন্দু থেকে, যা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য সুস্পষ্ট ও বোধগম্য ছিল। কারণ, যদি এই আন্দোলন গোপন বা গেরিলা যুদ্ধের মতো দীর্ঘায়িত ও অনিশ্চিত হয়ে যেত, তবে এটি ক্লান্তিকর এবং অকার্যকর হয়ে পড়তে পারত। তাই, তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এই সংগ্রামকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা, যাতে এটি বৃহত্তর জনসমর্থন পেতে পারে।
ইসলামের অংশ হিসেবে সংগ্রাম
আলোচনার ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখা যায়, আলেমরা ইরানের ধর্মপ্রাণ জনগণের মধ্যে এই চেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সাথে আপস না করেও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য সংগ্রামে অংশ নিতে পারেন। বরং, প্রকৃত ধর্মানুগত হওয়ার অর্থই হলো এই সংগ্রামে যুক্ত হওয়া। এক কথায়, রাজনৈতিক লড়াই একটি ধর্মীয় কর্তব্যের (ওয়াজিব) মর্যাদা লাভ করে। যেমন, বলা হতো:
"যদি কেউ বলে, আমি রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করব না, তবে এর অর্থ হলো, সে ইসলামের কিছু অংশকে এড়িয়ে যাচ্ছে।"
ইমাম খোমেনির নেতৃত্ব ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ
এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়িত্ব ও বিস্তারের ক্ষেত্রে ইমাম খোমেনির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি ধর্মীয় নেতৃত্বের ভিতরের একটি নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই ইরানের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে একটি নতুন প্রবণতা দেখা দেয়, যা কেবল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অর্থনীতি, বাণিজ্য, অবকাঠামো নির্মাণ এবং এমনকি রেডিও সম্প্রচার পরিচালনার মতো প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়।
এইভাবে, ইসলামী বিপ্লব কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের সংগ্রাম ছিল না, বরং এটি ছিল ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকার সম্প্রসারণ ও একটি নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সরাসরি সেই মতাদর্শের বিপরীতে অবস্থান নেয়, যা পূর্বে শিয়া আলেমদের কেবলমাত্র ধর্মীয়-দার্শনিক পরামর্শদাতা হিসেবে চিহ্নিত করত এবং তাঁদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখত।
তবে, নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণ নিয়ে আলোচনা করেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি ধর্মীয় নেতৃত্বকে প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রেও সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এটি এমন এক পরিবর্তন ছিল, যা পূর্বে কোনও শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতার বক্তব্যে শোনা যায়নি এবং এটি শিয়া আলেমদের রাজনৈতিক সংগ্রামে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে। এই চিন্তাধারা ধীরে ধীরে একটি বিকল্প শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে, যা পরিপূর্ণ বিপ্লবের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিপর্ব হয়ে ওঠে।
এই ধারাবাহিক পরিবর্তন প্রথমে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিজেদের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা করে। কিন্তু বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে এই আন্দোলন ইরানের বিপ্লবী সমাজের কাছে তার কাঙ্ক্ষিত নতুন শাসনব্যবস্থার রূপরেখা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এই নতুন শাসনব্যবস্থা ইসলাম ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিল, যা একদিকে ইরানের গভীর ধর্মীয় শিকড়ের প্রতি অনুগত থাকবে এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
এই নতুন আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল এমন এক শাসনব্যবস্থা, যার নেতা নিজেকে জনগণের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখতেন। তিনি বলেছিলেন: এই জনতার আওয়াজ আমার কাছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। তাই, তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন: ইসলামী সরকার প্রকৃত অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সরকার হবে। সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব মত প্রকাশ করতে পারবে। ইসলাম সব মতাদর্শের যুক্তিসঙ্গত জবাব দেওয়ার দায়িত্ব নেবে এবং ইসলামী সরকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কেবল যুক্তির মাধ্যমেই দেবে।
এই চিন্তাধারা শুধুমাত্র প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক মহলের একাংশের বিরুদ্ধেও একপ্রকার বিদ্রোহ ছিল। কারণ, এই নতুন রাজনৈতিক ধারণা আলেমদের এমন এক পরিসরে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে তাঁদেরকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। অনেকে মনে করতেন, এটি তাঁদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় মর্যাদার সাথে অসঙ্গত এবং এটি ধীরে ধীরে তাঁদের ধর্মীয় প্রভাবও ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
এই কারণে, বিপ্লবপন্থী আলেমদের অন্যতম প্রধান লড়াই ছিল ঐতিহ্যবাহী ধারার আলেমদের সাথে, যারা মনে করতেন ধর্মীয় নেতৃত্বকে রাজনীতির বাইরে থাকতে হবে। এই মতবিরোধ এতটাই তীব্র ছিল যে ১৯৭০ সালে ইমাম খোমেনি বিশেষ করে নজফের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আলেমদের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের সক্রিয়তার মধ্যে পার্থক্য টেনে বলেন:
ওরা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে, তবে তারা সজাগ এবং ইসলাম সম্পর্কে সচেতন। আমি ও আপনি প্রাচীন শিক্ষা গ্রহণ করেছি, কিন্তু আমরা ঘুমিয়ে আছি ও বন্দী হয়ে পড়েছি! এখানে তো একটি শব্দও উচ্চারণ করা যায় না! বলা হয়, ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে কথা বলা ঠিক নয়! আলেমের কথা বলারও নাকি অনুমতি নেই! আলেম নাকি চুপ থাকবে!
এই পরিবেশ কখনো কখনো এতটাই হতাশাজনক হয়ে উঠত যে বলা হতো:
আমরা আমাদের নিজেদের পরিবেশেই ইসলামী বিধানগুলো ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি না। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কেবল পবিত্রতা (তাহারাত)-সংক্রান্ত গ্রন্থের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এই লড়াই ছিল একটি বহুমাত্রিক সংগ্রাম, যার মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত এক ধর্মীয় কাঠামোকে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করতে হতো। এই ধর্মীয় কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে যদিও সরাসরি শাসকের হাতের অস্ত্র ছিল না, তবুও এটি এমন এক অবস্থানে ছিল, যেখানে সরকার ও ধর্মীয় নেতৃত্ব একপ্রকার বোঝাপড়ার মাধ্যমে সহাবস্থান করত—যেন একে অপরকে সম্মান দিত, তবে একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করত না। ইমাম খোমেনির ভাষায়, এটি ছিল এমন এক সম্মান, যা মৃত একজন ধর্মীয় নেতার প্রতি প্রদর্শিত সম্মানের মতো, যার বাস্তব কোনো ক্ষমতা নেই।
আপনার কমেন্ট