মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ - ০৯:০০
আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেনী

হাওজা / '২২ বাহমান' বখতিয়ারের পদত্যাগ ও পরিণতি; এটাই ইরানি জাতির বিপ্লবের আওয়াজ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩৫৭ সালের ২২ বাহমান (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) ইরানের ইসলামী বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনেই শাপুর বখতিয়ার এক টেলিফোন কথোপকথনের মাধ্যমে মেহদি বাজরগানের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা।

২১ ও ২২ বাহমান: এক ইতিহাস গড়ার মুহূর্ত

২১ ও ২২ বাহমান, ১৩৫৭ (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) সালে, পাহলভি শাসনের পতন ও ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

২১ বাহমান সকাল:

সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়।

বিপ্লবী বিমান বাহিনীর সদস্যরা জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দেন।

জনগণকে সামরিক কার্ডের বিনিময়ে অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করা হয়।


গণ-আক্রমণ ও বাহিনী দখল:

বিকাল ৪:৩০: পাঁচ ঘণ্টার সংঘর্ষের পর তেহরান-নো থানার পতন ঘটে।

একের পর এক পুলিশ স্টেশন জনতার হাতে চলে যায়।

সামরিক প্রশাসন রাত ৪:৩০ থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে, পরে এটিকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।


সেনা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি ও জনগণের প্রতিরোধ

সামরিক সরকার বিপ্লবী নেতাদের গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করে।

একটি তালিকায় শীর্ষ নেতাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ছিলেন ইমাম খোমেনি, আয়াতুল্লাহ তালকানি ও মেহদি বাজরগান।

কুজভিনের সাঁজোয়া বাহিনী তেহরানের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে, জনগণ তেহরান-কারাজ মহাসড়ক অবরোধ করে।

তেহরানের রাস্তায় সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ ঘটে।

সেনাবাহিনীর কিছু অংশ জনগণের সঙ্গে যোগ দেয়, ফলে বেশিরভাগ এলাকায় বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।


গার্ড বাহিনীর পতন

বিপ্লবী বাহিনী গার্ড বাহিনীর প্রথম বড় ধরনের হামলা প্রতিহত করে।

৩০টি ট্যাংকের মধ্যে মাত্র কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে সক্ষম হয়।

তেহরানের গরগান রোডের থানায় আক্রমণ হয়, যেখানে জনগণের হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রধান কর্মকর্তা ও সহকারীকে হত্যা করা হয়।


এই দিনগুলোতে সংঘটিত ঘটনাগুলোই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সফল পরিণতি নিশ্চিত করে, যা শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের পতন ও নতুন ইসলামী শাসনব্যবস্থার সূচনা ঘটায়।

কাসর কারাগার দখল ও সাভাকের অবরোধ

সকাল ১০টায় কাসর কারাগারে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হয়। এটি ছিল ইরানের বৃহত্তম কারাগার, যেখানে বছরের পর বছর বিপ্লবী নেতাদের বন্দি রাখা, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। কারাগারটি মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই অভিযানের সময় অনেক বিপ্লবী শহীদ হন, কিন্তু তাদের রক্তেই কারাগারের দরজা খুলে যায় এবং বন্দিরা মুক্তি লাভ করেন।

এছাড়াও, সেনাবাহিনীর অস্ত্রাগার, এভিন কারাগার, সাভাকের সুলতানতাবাদ সদর দপ্তর, সেনেট ও পার্লামেন্ট ভবন, রেডিও-টেলিভিশন কেন্দ্র, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জেন্ডারমেরি ও পুলিশ সদর দপ্তর জনগণের দখলে চলে যায়।

হেশমতিয়েহ সেনানিবাসের পতন

সকাল ৭টা থেকে হেশমতিয়েহ সেনানিবাস অবরুদ্ধ ছিল, যেখানে কমান্ডার কর্নেল আরামি নিহত হন। দীর্ঘ প্রতিরোধের পর দুপুর ১টার দিকে বিপ্লবী জনতা পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙে প্রবেশ করে। অনেকে সেনা পোশাক ফেলে সাধারণ পোশাকে পালিয়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনানিবাসও জনগণের হাতে চলে যায়।

সাভাক সদর দপ্তর ও কমিটি কারাগারের পতন

এই সময়ে, বাগশাহ সেনানিবাসের ওপরও জনতা আক্রমণ চালায়। সাভাক সদর দপ্তর ও কমিটি কারাগার, যা বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের কেন্দ্র ছিল, সেগুলোও অবরুদ্ধ হয়। বিকাল ৪টার দিকে, বিপ্লবীরা একটি ট্যাংক দখল করে তার সাহায্যে ভবনটিতে গুলি চালায়, ফলে সাভাকের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং এটি জনগণের নিয়ন্ত্রণে আসে।

প্রধান সরকারি ভবনগুলোর দখল

বিপ্লবীরা গোলেস্তান প্রাসাদ, ইরানের জাতীয় রেডিও কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় জেন্ডারমেরি, পুলিশ একাডেমি ও সামরিক স্কুল দখল করে। কমিটি কারাগার, যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালানো হতো, সেটিও জনতার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং বন্দিরা মুক্তি পান।

চূড়ান্ত বিজয় ও শেষ সামরিক ঘোষণা

দিনের শেষদিকে, সব থানাসহ সামরিক ও নিরাপত্তা ঘাঁটিগুলো জনগণের হাতে চলে যায়। কাসর ও জামশিদিয়েহ কারাগার দখল করা হয়। পালিয়ে যাওয়া কিছু বন্দিকে জনগণ ধরে রেফাহ স্কুলে (ইসলামী বিপ্লব পরিষদের সদর দপ্তর) হস্তান্তর করে।

সেনাবাহিনী তাদের শেষ ঘোষণা জারি করে, যাতে সৈন্যদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ফিরে যেতে বলা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর পলায়ন ও গার্ডের আত্মসমর্পণ

এদিকে, যখন জনগণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, বখতিয়ার তার অর্ধসমাপ্ত মধ্যাহ্নভোজ রেখে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর গার্ডরা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে, ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদও জনগণের দখলে চলে যায়।

সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার

সেপাহবদ রহিমি (তেহরানের সামরিক গভর্নর ও পুলিশের প্রধান) জনগণের হাতে বন্দি হন।

সারলশকর নাজি (রাজকীয় গার্ডের কমান্ডার) ফুজিয়া স্কয়ারে (বর্তমানে ইমাম হুসেইন স্কয়ার) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

নঈমতুল্লাহ নাসিরি (সাভাক প্রধান) জনগণের হাতে বন্দি হন।


নতুন সরকারের ঘোষণা

মেহদি বাজরগান এক টেলিভিশন ভাষণে জনগণকে ধন্যবাদ জানান এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রশংসা করেন। তিনি জানান, জেনারেল কারবাগি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এইসব ঘটনাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha