হাওজা নিউজ এজেন্সি: সিলাতুর রাহম শুধু আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করাই নয়, বরং এটি একটি আবেগিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন যা সম্পর্ককে জীবন্ত রাখে এবং জীবনে বরকত আনে। এটি ইসলামের একটি মৌলিক ধারণা, যা পরিবার ও আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখাকে নির্দেশ করে। কুরআন ও হাদিসে এটিকে আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ১নং আয়াতে বলেন:
«وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ»
(অর্থ: "আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে জিজ্ঞাসা করো এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো।")
এই আয়াতটি সিলাতুর রাহমের গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
সিলাতুর রাহমের সংজ্ঞা ‘
সিলাতুর রাহম’ শব্দটি দুটি অংশে গঠিত: ‘সিলাতুন’ অর্থ সম্পর্ক বা বন্ধন এবং ‘রাহম’ অর্থ আত্মীয়তা। সুতরাং, সিলাতুর রাহম হলো আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের খোঁজখবর নেওয়া। এটি শুধু শারীরিকভাবে দেখা-সাক্ষাৎ করাই নয়, বরং আর্থিক সাহায্য, মানসিক সমর্থন এবং এমনকি ফোন, ভিডিও কল বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত। সিলাতুর রাহিম শুধু নিকটাত্মীয়দের সাথেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাকে বোঝায়।
সিলাতুর রাহমের গঠনমূলক দিকসমূহ
১. আল্লাহর রহমত লাভ
সিলাতুর রাহম আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম মাধ্যম। হাদিসে এসেছে:
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ، وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ، فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
(অর্থ: "যে ব্যক্তি চায় যে, তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।")
(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৫৯৮৫)
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, সিলাতুর রাহম শুধু পার্থিব সুবিধাই দেয় না, বরং এটি আধ্যাত্মিক কল্যাণও বয়ে আনে।
২. সামাজিক বন্ধন শক্তিশালীকরণ
‘সিলাতুর রাহম’ সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এটি সমাজে সংহতি বৃদ্ধি করে এবং উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। আত্মীয়দের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি
আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা একাকীত্বের অনুভূতি কমায় এবং ব্যক্তির মধ্যে সম্পৃক্ততার অনুভূতি বাড়ায়। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপের মতো সমস্যা প্রতিরোধ করে। পারিবারিক বন্ধন মানসিক স্থিতিশীলতা ও সুখের একটি বড় উৎস।
৪. একটি উন্নত সমাজ গঠন
সিলাতুর রাহম একটি নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে সমাজে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি করে। যে সমাজে পারিবারিক বন্ধন মজবুত, সে সমাজে সামাজিক সমস্যা কম দেখা যায়। এটি সমাজে ন্যায়বিচার, সহানুভূতি ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে।
৫. আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
আল্লাহ তাআলা সূরা রা’দে বলেন:
«وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ»
"যারা আল্লাহর আদেশ মেনে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে এবং তাদের রবকে ভয় করে এবং কঠোর হিসাবের ভয় করে।") (রাদ: ২১)
এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আল্লাহর আদেশ এবং এটি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম।
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
«لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ»
(অর্থ: "আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।") (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৫৬)
এই হাদিসটি সিলাতুর রাহমের গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়।
সিলাতুর রাহমের প্রতিবন্ধকতা ও তার সমাধান
আজকের ব্যস্ত জীবনে কাজের চাপ, ভৌগোলিক দূরত্ব এবং প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার সিলাতুর রাহমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন: ফোন, ভিডিও কল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও, নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই বন্ধন রক্ষা করা সম্ভব।
প্রযুক্তির ব্যবহার সিলাতুর রাহমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো এবং স্কাইপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে আত্মীয়দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা যায়। তবে, প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু ভার্চুয়াল যোগাযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে দেখা-সাক্ষাৎ ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সম্পর্ককে আরও গভীর করা উচিত।
উপসংহার
সিলাতুর রাহম শুধু একটি ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং এটি আল্লাহর বরকত ও রহমত লাভের মাধ্যম। এটি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে একটি উন্নত ও সুস্থ সমাজ গঠনে সাহায্য করে। কুরআন ও হাদিসে সিলাতুর রাহমের গুরুত্বের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, তাই আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এই মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
আমাদের উচিত আত্মীয়দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা, তাদের খোঁজখবর নেওয়া এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। এতে করে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব এবং একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
নাজমুল হক (কোম, ইরান)
আপনার কমেন্ট