৮ শাওয়াল: জান্নাতুল বাকীর বেদনা ও আমাদের দায়িত্ব"
"وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ"
“যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের সম্মান করে, তবে নিশ্চয়ই তা হৃদয়ের তাকওয়ার পরিচায়ক।”
—সূরা হজ্ব (২২:৩২)
ভূমিকা:
ইসলামি ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি হলো ৮ শাওয়াল, যখন সৌদি ওয়াহাবি শাসকদের নির্দেশে মদিনার পবিত্র জান্নাতুল বাকী কবরস্থান ধ্বংস করা হয়। এই কবরস্থানে ছিলেন ইসলামের অগণিত সাহাবি, আহলে বাইতের সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। তাদের সম্মানিত কবরগুলোর সাথে এই বর্বরোচিত আচরণ শুধু ইতিহাসের পাতায় একটি কলঙ্কই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গভীর শিক্ষাও বটে। আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের কী করণীয়—তা নিয়েই বর্তমান নিবন্ধে আলোচনা করবো।
জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের ইতিহাস:
প্রথম ধ্বংস যজ্ঞ (১৮০৬ ও ১৮১৮ সাল):
প্রথম বারের মতো জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের ঘটনা ঘটে ১৮০৬ সালে, যখন ওয়াহাবি বাহিনী মদিনা দখল করে। তারা কবরস্থানের মাজারগুলো ভেঙে ফেলে এবং ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ মদিনা পুনর্দখল করলে কবরগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়।
চূড়ান্ত ধ্বংস (১৯২৫ সাল, ৮ শাওয়াল ১৩৪৪ হিজরি):
১৯২৫ সালে সৌদি বাহিনী মদিনা দখল করার পর, রাজা আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের নির্দেশে জান্নাতুল বাকী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। ৮ শাওয়াল তারিখে এই নির্মম কাজটি সম্পন্ন হয়। কবরস্থানের সকল গম্বুজ, স্মৃতিস্তম্ভ এবং চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। যেসব মহান ব্যক্তিদের কবর ধ্বংস করা হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:
বাকীর চারজন ইমাম হচ্ছেন দ্বাদশ ইমামের অন্তর্ভুক্ত, এবং অতীতে তাঁদের মাজার জান্নাতুল বাকীর অন্যান্য মাজারগুলোর পাশে একটি গম্বুজ ও ইমারত বিশিষ্ট ছিল, যা ১৩৪৪ হিজরীতে ওহাবিদের নির্দেশে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
১. ইমাম হাসান ইবনে আলী (আঃ) – শাহাদাত: ৫০ হিজরী
২. ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) – শাহাদাত: ৯৫ হিজরী
৩. ইমাম বাকির (আঃ) – শাহাদাত: ১১৪ হিজরী
৪. ইমাম সাদিক (আঃ) – শাহাদাত: ১৪৮ হিজরী
যখন মহানবী (সা.) জান্নাতুল বাকী বাগানটিকে মুসলমানদের মৃতদেহ দাফনের জন্য নির্ধারণ করেন, তখন তাঁর কিছু আত্মীয় স্বজনকেও এই কবরস্থানে দাফন করা হয়। ইতিহাসে তাঁদের কারো নাম লিপিবদ্ধ আছে, আবার অনেকের জন্য সেই সময় গম্বুজ ও কবরস্থ স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে পরবর্তীকালে ওহাবিদের মদীনায় হামলার সময় এসব কাঠামো ধ্বংস করে ফেলা হয়।
নবী (সা.)-এর চাচারা:
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (মৃত্যু: ৩২ হিজরী)
নবী (সা.)-এর ফুফুরা:
১. সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব (মৃত্যু: ২০ হিজরী)
২. আতিকা বিনতে আবদুল মুত্তালিব (হিজরতের দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন)
নবী (সা.)-এর দাইমা (দুধ মা):
হালিমা সা’দিয়া (মৃত্যু: ৮ হিজরী)
নবী (সা.)-এর স্ত্রীগণ:
১. জয়নব বিনতে খুযাইমা (মৃত্যু: ৪ হিজরী)
২. মারিয়া কিবতিয়া (মারিয়া বিনতে শামউন, মৃত্যু: ১৬ হিজরী)
৩. জয়নব বিনতে জাহশ (মৃত্যু: ২০ হিজরী)
৪. হাফসা বিনতে উমর ইবনে খাত্তাব (মৃত্যু: ৪৫ হিজরী)
৫. সাফিয়া বিনতে হুয়াইয়্য ইবনে আখতাব (মৃত্যু: ৫০ হিজরী)
৬. সওদা বিনতে যামা ইবনে কায়স (মৃত্যু: ২৩ বা ৫৪ হিজরী)
৭. জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস (মৃত্যু: ৫৬ হিজরী)
৮. আয়েশা বিনতে আবু বকর (মৃত্যু: ৫৮ হিজরী)
৯. উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া মাখযুমি (মৃত্যু: ৬২ হিজরী)
নবী (সা.)-এর সন্তানগণ:
১. রুকাইয়া বিনতে রাসূলুল্লাহ (মৃত্যু: ২ হিজরী)
২. জয়নব বিনতে রাসূলুল্লাহ (মৃত্যু: ৮ হিজরী)
৩. উম্মে কুলসুম বিনতে রাসূলুল্লাহ (মৃত্যু: ৯ হিজরীর শা’বান মাসে)
৪. ইব্রাহিম ইবনে রাসূলুল্লাহ (মৃত্যু: ১০ হিজরী)
নবী (সা.)-এর বংশধরগণ (নাতি-নাতনি):
১. জয়দ ইবনে হাসান ইবনে আলী (আ.) (মৃত্যু: ১২০ হিজরী)
২. ইসমাঈল ইবনে জাফর (মৃত্যু: ১৩৮ হিজরী)
৩. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হাসান (নফসে জাকিয়া) (শহীদ: ১৪৫ হিজরী)
এছাড়াও অন্যান্য সাহাবা ও তাবেইন ও ওলামাগণ ও শোহাদাগণের কবর ওখানে অবস্থিত।
ওয়াহাবি মতবাদ অনুযায়ী, কবরকে সম্মান দেখানো বা তার উপর গম্বুজ নির্মাণ করা "শির্ক" হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অজুহাতে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত ইসলামি ঐতিহ্য ধ্বংস করে।
বর্তমান সময়ে আমাদের করণীয়:
১. সচেতনতা বৃদ্ধি:
জান্নাতুল বাকীর ইতিহাস সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে, বিশেষত নতুন প্রজন্মকে। সোশ্যাল মিডিয়া, সেমিনার, বই-পুস্তকের মাধ্যমে এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
২. ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষণ:
প্রাচীন ফটোগ্রাফ, মানচিত্র ও লিখিত দলিল সংগ্রহ করে জান্নাতুল বাকীর মূল রূপ সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. শান্তিপূর্ণ আন্দোলন:
আন্তর্জাতিক ফোরামে সৌদি সরকারের কাছে জান্নাতুল বাকী পুনর্নির্মাণের দাবি জানাতে হবে। শান্তিপূর্ণ প্রচারণা, পিটিশন ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করা প্রয়োজন।
৪. ঐক্যবদ্ধতা:
সুন্নি-শিয়া বিভেদ ভুলে গিয়ে সকল মুসলিমকে এই ঐতিহাসিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে হবে। এটি শুধু একটি মাজারের বিষয় নয়, বরং ইসলামি সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার লড়াই।
৫. আধ্যাত্মিক সংযোগ:
যেহেতু আমরা এই পবিত্র স্থানগুলো জিয়ারত করতে পারছি না, তাই দূর থেকে তাদের স্মরণে দোয়া, মিলাদ ও আলোচনার মাধ্যমে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া:
জান্নাতুল বাক্বী এবং অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলোর ধ্বংস সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ওহাবিদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ও দুঃখের ঢেউ তৈরি করে। বহু ইসলামি ও অন ইসলামি দেশ থেকে ধর্মীয় ও অ-ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ওহাবিদের এই ভুল কাজের নিন্দা জানান।
আজারবাইজান, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, ইরাক, চীন, মঙ্গোলিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশের মানুষ চিঠিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের দুঃখ প্রকাশ ও প্রতিবাদ জানায় এবং এই ঘটনার মাধ্যমে মসজিদে নববীর ধ্বংসের আশঙ্কাও প্রকাশ করে।
কিছু ইসলামি দেশ, বিশেষ করে ইরান, সরকারিভাবেই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় এবং বিভিন্ন উপায়ে এর প্রতিবাদ করে।
উপসংহার:
৮ শাওয়াল শুধু একটি তারিখ নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি পরীক্ষা। জান্নাতুল বাকীর ধ্বংস আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতন হতে হবে। আজকের দায়িত্ব হলো—অন্ধকারকে জ্ঞানের আলোয় পরাজিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সত্য ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া।
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাহায্য ও বিজয় দান করবেন এবং মুমিনদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন।" (সূরা নূর, ৫৫)
লেখক:কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ:০৮/০৪/২০২৫
এই নিবন্ধটি শেয়ার করে অন্যকে জান্নাতুল বাকীর ইতিহাস জানাতে সাহায্য করুন। #SaveJannatulBaqi #8Shawal
আপনার কমেন্ট