হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম সাদিক (আ.) জাফরি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান। কয়েকটি অনুকূল পরিস্থিতির সম্মিলনে ইমাম ষষ্ঠ (আ.) ইসলামী জ্ঞান প্রচার করতে সক্ষম হন এবং রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান তাঁর অদম্য প্রচেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ে।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা চেষ্টা করেছিল জ্ঞানার্জনকে অহলে বাইত (আ.)-এর বাইরে নিয়ে যেতে এবং ধর্মীয় বিষয়াদি অহলে বাইত (আ.) ছাড়া অন্যত্র সমাধান করতে। তারা এ উদ্দেশ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছিল যাতে ধর্মীয় জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু অহলে বাইত (আ.)-এর পরিবর্তে অন্যদের দিকে স্থানান্তরিত হয়। তাই তারা ইমামদের সমকালীন অন্যান্য ফকীহদেরকে প্রাধান্য দিত। কিন্তু ইমাম সাদিক (আ.)-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টা এসব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় এবং ধর্ম তাঁর নাম ও প্রচেষ্টায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করে।
জাফরি মাযহাব জালিম শাসকদের মাযহাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধর্মকে জীবিত রাখার কারণ হয়ে ওঠে।
প্রধান কারণসমূহ:
১. ইমাম সাদিক (আ.)-এর ইমামতকাল ছিল তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ - ৩০ বছরেরও বেশি। যদিও তাঁর দাদা ইমাম যায়নুল আবেদিন (আ.), পুত্র ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.) ও নাতি ইমাম আলি নাকি (আ.)-এর ইমামতকালও ৩০ বছর অতিক্রম করেছিল, কিন্তু ইমাম সাদিক (আ.)-এর জন্য যে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা অন্য ইমামদের জন্য হয়নি।
২. ইমাম সাদিক (আ.)-এর যুগ ছিল ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব, বিতর্ক ও হাদীস চর্চার স্বর্ণযুগ। তাঁর সময়ে বিভিন্ন বিদআত, নতুন মতবাদ ও ভ্রান্ত ধারণার প্রসার ঘটেছিল, যা ইমামকে সঠিক জ্ঞান প্রচার এবং ভ্রান্তির মূলোৎপাটনের সুযোগ দিয়েছিল।
৩. তাঁর ইমামতকালে বনি হাশিম পূর্ববর্তী যুগগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ছিল, যা অন্যান্য ইমামদের জন্য সৃষ্টি হয়নি। তাই ইমাম সময় ও পরিস্থিতির সর্বোত্তম ব্যবহার করে পূর্ণ শক্তি দিয়ে ইসলামের আসল মাযহাবকে “জাফরি মাযহাব” নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শিয়া মতবাদের সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করেছিলেন।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব:
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে ইমাম সাদিক (আ.)-এর জ্ঞানচর্চার আন্দোলন অতুলনীয়। তিনি ইসলামী সভ্যতাকে নতুন প্রাণ দান করেছিলেন। অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ, সমাজের জ্ঞানপিপাসা এবং বিদ্যমান সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তিনি তাঁর পিতা ইমাম বাকির (আ.)-এর জ্ঞানচর্চার ধারা অব্যাহত রাখেন এবং একটি বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে হিশাম ইবনে হাকাম, মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম, আবান ইবনে তাগলিব, মুমিন তাক, মুফাদ্দাল ইবনে উমর, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখ বিশিষ্ট শিষ্য গড়ে তোলেন - যাদের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর শিক্ষাকেন্দ্রের ব্যাপ্তি:
ইমাম সাদিক (আ.) তৎকালীন সকল চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং ইসলাম ও শিয়াদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। আহলে সুন্নাতের অনেক প্রসিদ্ধ নেতাই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইমামের শিষ্য ছিলেন। এদের মধ্যে আবু হানিফা অন্যতম, যিনি দুই বছর ইমামের শিষ্য ছিলেন। তিনি এই দুই বছরকে তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, “ঐ দুই বছর না হলে নুমান (আবু হানিফা) ধ্বংস হয়ে যেত।”
কেন শিয়া ফিকহ ”জাফরি ফিকহ” নামে পরিচিত?
আব্বাসীয় শাসকরা জনগণকে অহলে বাইত (আ.) থেকে দূরে রাখতে বিশেষ ফিকহি মাযহাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা অহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের সমকক্ষ কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ইমাম সাদিক (আ.)-এর ফিকহি মতবাদসমূহ সকলের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তাঁর শিষ্যরা সর্বত্র “জাফর ইবনে মুহাম্মাদ” নামে ফতোয়া ও হাদীস প্রচার করতে থাকেন। এভাবেই জাফরি ফিকহ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর তিন বিশিষ্ট শিষ্য:
১. *জাবির ইবনে হাইয়ান:* রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত ৫০০টি রিসালা নিয়ে এক হাজার পাতার একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
২. হিশাম ইবনে হাকাম: শিয়া মতবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক। ইমাম সাদিক (আ.) তাঁকে "আমাদের হকের রক্ষক" বলে আখ্যায়িত করেন।
৩. মালিক ইবনে আনাস: মালিকি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর শিষ্য ছিলেন এবং বলতেন: “আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় ফকিহ কাউকে দেখিনি।”
এভাবে ইমাম সাদিক (আ.)-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শিয়া ফিকহ “জাফরি ফিকহ” নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে তোলে।
আপনার কমেন্ট