হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী আজ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদত বার্ষিকীর শোকসভায় বলেন, ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ে আল্লাহর পরিকল্পনায় (তাকদিরে ইলাহিতে)– যা কিনা আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (কাজায়ে মাহতুম) নয়– ইমামদের পক্ষে একটি পরিবর্তন ঘটার কথা ছিল। বিভিন্ন হাদিস থেকে এটি বোঝা যায়। একটি হাদিসে ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,
اِنّ اللهَ قَدّرَ هذا الاَمرَ فی سَنَةِ سَبعین (১)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ এই বিষয়টি (ইমামতের প্রকৃত ক্ষমতা) ৭০ হিজরিতে নির্ধারণ করেছিলেন।”
আপনি দেখুন, যখন ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করলেন, কিছু লোক এসে অভিযোগ করল। তিনি (আ.) বললেন,
ما تَدری لَعَلَّه فِتنَةٌ لَکُم وَ مَتاعٌ الی حین.
“তুমি জান না, এটি হয়তো তোমাদের জন্য একটি পরীক্ষা এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুযোগ।” অর্থাৎ ইমাম হাসান (আ.)-এর বাণীতে ইঙ্গিত ছিল যে এই কুফর ও মুনাফিকদের আধিপত্য স্থায়ী হবে না; এটি আল্লাহর পরিকল্পনায় অস্থায়ী। কতদিন? ৭০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ এই হাদিস অনুযায়ী, ৭০ হিজরিতে আহলে বাইতের যে কেউ জীবিত থাকবেন, তিনি বিদ্রোহ করবেন ও ক্ষমতা গ্রহণ করবেন, এবং প্রকৃত ইমামত প্রতিষ্ঠিত হবে। এরপর ইমাম হাসান (আ.) বলেন,
فَلَمّا قُتِلَ الحُسینُ علیه السلام اِشتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلی اَهلِ الاَرضِ فَاَخَّرَهُ اِلی مِئَةٍ وَ اَربَعین
“কিন্তু যখন হুসাইন (আ.) শহীদ হলেন, পৃথিবীবাসীর উপর আল্লাহর ক্রোধ বৃদ্ধি পেল এবং তিনি এটি ১৪০ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দিলেন।” অর্থাৎ কারবালার ঘটনা, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অবহেলা, তাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া—এর প্রভাবে আল্লাহর এই পরিকল্পনা পিছিয়ে গেল ১৪০ সাল পর্যন্ত। ১৪০ সাল হলো ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়, যিনি ১৪৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। শিয়ারা এটি জানত। অর্থাৎ শিয়াদের বিশেষজ্ঞরা এটি জানত। যেমন একটি হাদিসে আছে, যুরারা (ইমামের নিকটবর্তী সাহাবীদের একজন) তার সঙ্গীদের বললেন,
لا تَری عَلی أعوادِها اِلّا جعفراً (২)
“তুমি শুধু জাফরকেই (ইমাম সাদিক) সিংহাসনে দেখবে।”
অথবা আরেকটি হাদিসে যুরারা (যিনি কুফার বাসিন্দা ছিলেন) ইমাম সাদিক (আ.)-কে বার্তা পাঠালেন যে আমাদের একজন বন্ধু ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন এবং ঋণদাতারা তাকে তাড়া করছে। তিনি টাকা না থাকায় শহর ছেড়ে চলে গেছেন। যদি এই ইমামতের বিষয়টি এক-দুই বছরের মধ্যে ঘটে, তাহলে সে আপনার ক্ষমতায় আসার অপেক্ষা করবে এবং সমস্যার সমাধান হবে; কিন্তু যদি এটি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বন্ধুরা টাকা সংগ্রহ করে তার ঋণ শোধ করবে। (৩)
অর্থাৎ যুরারার মতো লোকেরা জানতেন যে এক-দুই বছরের মধ্যে বিষয়টি শেষ হবে। এজন্যই আপনি দেখেন তারা ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে এসে বারবার বলত, ইমাম, “আপনি কেন বিদ্রোহ করছেন না?”
এরপর তিনি সেই হাদিসের ধারাবাহিকতায় বলেন, “তোমরা (শিয়ারা) যদি গোপনীয়তা রক্ষা করতে, তাহলে হয়তো সেই সময়েই বিষয়টি শেষ হয়ে যেত; এবং তুমি দেখতে ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো!” মানবজাতির গতিপথ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, এবং আজকের বিশ্ব অন্যরকম হতো। অর্থাৎ আমাদের অবহেলা, অযথা কথা বলা, সাহায্য না করা, অকারণে প্রতিবাদ করা, ধৈর্য না ধারণ করা, পরিস্থিতি ভুল বিশ্লেষণ করা—এসব ঐতিহাসিক প্রভাব ফেলে। এটি গতিপথই বদলে দিতে পারে। তাই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
ইমাম সাদিক (আ.)-এর জীবন ছিল অত্যন্ত অসাধারণ, বিস্ময়কর ও সফল—বিশেষ করে আল্লাহর বিধান প্রচার ও তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে। তবে যে চার হাজার শিষ্যের কথা বলা হয়, শ্রোতা ভাবতে পারেন যে তিনি যখন কোনো ক্লাস শুরু করতেন, চার হাজার লোক সেখানে বসতেন; বিষয়টি তা নয়। তাঁর জীবদ্দশায় চার হাজার লোক তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন—এভাবেই এই সংখ্যা এসেছে। অর্থাৎ তাঁর চার হাজার রাবি (হাদিস বর্ণনাকারী) ছিল; এটা এই অর্থে চার হাজার শিষ্য, না যে তিনি একসাথে চার হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াতেন।
আমরা ইমামদের জীবন আদর্শ থেকে অনেক দূরে; তাদের বাণী, বক্তব্য, হাদিস ও জীবনাচার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত।
আমাদের কিছু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)’কে খলিফা মানসুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং মানসুর তাঁকে ক্রোধ দেখালে তিনি (আ.) বলেছিলেন, “হে আমার চাচাতো ভাই! নবী-রাসূলরা নির্যাতিত হয়েছেন, তারা ক্ষমা করেছেন, আপনিও আমাদের ক্ষমা করুন।”
সর্বোচ্চ নেতা এই রেওয়ায়ত বর্ণণাপূর্বক বলেন, আমি দৃঢ়তার সাথে বলছি, এটি মিথ্যা; এটি কোনোভাবেই সত্য নয়। ইমাম কখনোই এমন কথা বলেননি—হুমকি যাই থাকুক না কেন। বর্ণনাকারী কে? রাবি এমন একজন—যে মানসুরের সেবক ছিল! সে একজন দরবারি মিথ্যাবাদী। সে এই কথা বর্ণনা করেছে ইমাম সাদিক (আ.)-এর নামে। এটি শিয়াদের মনোবল ভাঙার জন্য একটি হাতিয়ার। তাই এসব বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। কিছু মানুষ অযথা এগুলো বর্ণনা করে, অথচ এগুলো সঠিক হাদিস নয়। ইমামগণ ছিলেন সংগ্রাম, অটলতা ও যুক্তির শিক্ষক; তারা যুক্তি, প্রমাণ ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে অন্যদের মোকাবেলা করতেন।
আপনি দেখুন, হযরত যায়নাব (সা.) ইবনে জিয়াদের দরবারে, ইয়াজিদের সামনে কীভাবে বক্তব্য রেখেছিলেন? সেটাই সঠিক পন্থা; সেটাই ইমামদের প্রকৃত পথ। যে কেউ সংগ্রাম করে, সে এই মহান ব্যক্তিত্বদের পথেই চলছে। আজ গাজা ও লেবাননে যারা সংগ্রাম করছে, তারাও বাস্তবে এই ইমামদের পথেই কাজ করছে।
(১) আল-কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৬৮
(২) রিজাল কাশি, পৃষ্ঠা ১৫৬
(৩) রিজাল কাশি, পৃষ্ঠা ১৫৭
আপনার কমেন্ট