হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.)-এর ফজিলত ও গুণাবলি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করুন
যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, “বাকরুলউলুম” উপাধিটি ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট। তাঁর যুগে, ইসলামের আবির্ভাবের এক শতাব্দী পরে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে ইমাম একটি বিশেষ জ্ঞানভিত্তিক ভূমিকা পালনের উপযুক্ত সুযোগ পান।
রাসূলুল্লাহ (সা.) জাবির ইবনে আবদুল্লাহকে বলেছিলেন:
"إنّکَ ستُدرِکُ رجُلاً مِنّی، اسمُه اسْمِی و شَمائلُهُ شَمائلی یَبْقَرُ العِلْمَ بَقْرا"
"তুমি আমার একজন বংশধরকে পাবে, যার নাম হবে আমার নামের মতো এবং চরিত্র হবে আমার মতো; এবং সে জ্ঞানকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করবে।"
— (বিহারুল আনওয়ার, মজলিসি, খণ্ড ৪৬, পৃষ্ঠা ২৯৪)
এই বিখ্যাত হাদীসটি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারিকে রাসূল (সা.) বলেছিলেন। এতে রাসূল (সা.) শুধু ইমাম বাকের (আ.)-কে নয়, অন্যান্য ইমামদের নামসহ পরিচয় দিয়েছেন। এই সম্মান শুধু শিয়াদের মধ্যেই নয়, সুন্নি পণ্ডিতদের কাছেও ইমামের উচ্চ মর্যাদা স্বীকৃত।
উদাহরণস্বরূপ, সুন্নি বিদ্বান “যাহাবী”, যিনি শিয়াদের সাথে সহানুভূতিশীল ছিলেন না এবং অনেকেই তাকে “নাসেবি” (আহলুল বাইতের শত্রু) বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনিও ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.) সম্পর্কে বলেন:
"سید، امام، فقیه و یصلح للخلافة"
"তিনি ছিলেন নেতা, ইমাম, ফকীহ এবং খিলাফতের জন্য যোগ্য।"
— (সিয়ার আ'লাম আল-নুবালাঃ খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪০২)
আরেক জায়গায় তিনি বলেন,
"و کان أحد من جمع بین العلم و العمل و السؤدد"
"তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যিনি জ্ঞান, আমল ও মর্যাদার সমন্বয় ঘটিয়েছেন।"
প্রখ্যাত মুফাসসির ফখরুদ্দিন রাজি, যিনি শিয়া ও সুন্নি উভয় মহলে গ্রহণযোগ্য, কাওসার সূরার তাফসিরে বলেন:
"কাওসার" বলতে ফাতিমা (আ.)-কে বোঝানো হয়েছে, কারণ তাঁর বরকতময় সন্তানদের দ্বারা পৃথিবী পূর্ণ থাকবে। অনেকেই আহলুল বাইত থেকে শহীদ হয়েছেন, কিন্তু দুনিয়া আজও তাঁদের উত্তরসূরীতে পূর্ণ।
তিনি আরও বলেন:
"ইমাম বাকার, সাদিক, কাজিম ও রেজা (আ.) এর মত মহৎ ব্যক্তিত্বেরা আহলুল বাইতের উত্তরসূরি।"
— (তাফসিরে রাজি, খণ্ড ৩২, পৃষ্ঠা ১২৪)
আরেকজন সুন্নি পণ্ডিত আবদুল্লাহ ইবনে আতা বলেন:
"আমি কখনো দেখিনি কোনো আলেমকে ইমাম আবু জাফর (ইমাম বাকার)-এর সামনে এত ছোট ও অক্ষম লাগতে, যেমনটা দেখেছি।"
— (তাযকিরাত খাওয়াসুল উম্মাহ, সিবত ইবনে জাওযি, পৃষ্ঠা ৩৩৭)
এসব দলিল প্রমাণ করে যে ইমাম বাকের (আ.)-এর মর্যাদা শুধু শিয়াদের কাছে নয়, বরং ন্যায়পরায়ণ সুন্নিদের কাছেও অত্যন্ত উঁচু।
ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.)-এর সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল এবং তিনি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে খাঁটি ইসলাম ও শিয়াপন্থা রক্ষা করেছিলেন?
ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.)-এর ইমামতির সময়কাল ছিল বনু উমাইয়ার শাসকদের শিয়া নিপীড়নের যুগ। এই সময়ে ইমাম তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলেন:
"من بلی من شیعتنا ببلاء فصبر کتب الله له اجر الف شهید"
"যে কেউ আমাদের শিয়াদের মধ্যে বিপদে পতিত হয়ে ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ তাকে এক হাজার শহীদের সওয়াব দান করবেন।"
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, সেই সময় শিয়ারা প্রবল নিপীড়নের শিকার ছিল এবং ইমাম তাদের ধৈর্য ও প্রতিরোধে উৎসাহিত করতেন। এই নিপীড়নের কারণ ছিল তাঁদের ইমামতের দাবি।
এই কঠিন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.) তার দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে গোপনে এবং বিচক্ষণভাবে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেন। তিনি একটি চিন্তাশীল ও জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেন। এতে তিনি রাসূল (সা.)-এর সাহাবাদের উত্তরসূরি, তাবেঈনদের মধ্যে বিদ্বান ও ফকীহদের একত্র করে তাদের প্রকৃত ইসলামিক জ্ঞান ও তত্ত্ব শিক্ষা দেন।
এই আন্দোলনই ছিল ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বিশাল শিক্ষাজাগরণের ভূমিকা। পরবর্তী সময়ে ইমাম সাদিক (আ.) প্রায় ৪০০০ এর অধিক ছাত্রকে শিক্ষা দেন, যা শিয়াদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ভিত্তি রচনা করে। এর ফলেই শিয়া মতবাদ দর্শনে, ফিকাহে ও ক্যালামে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে যায়।
এই কারণেই আমাদের "শিয়া জাফরিয়া" বলা হয় — এই জ্ঞানের ভিত যাঁরা নির্মাণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম হলেন ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.)।
আপনার কমেন্ট