মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ - ২২:৩৬
জিহাদে তাবিয়িন: ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর চিরন্তন শিক্ষা

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর, যখন ইতিহাসের পাতা নিঃশব্দে রক্তে ভিজে যাচ্ছিল, তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.) দুঃসহ নিপীড়নের মাঝেও এক দীপ্ত বার্তাবাহক হয়ে উঠেছিলেন। দোয়া, ভাষণ ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতির মাধ্যমে তিনি শুরু করেন এক অনন্য জিহাদ—"জিহাদে তাবিয়িন"—যার মাধ্যমে তিনি সত্যের আলো জ্বালিয়েছিলেন শাম ও কুফার অন্ধকারে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন কীভাবে অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আমরা এমন এক শোকাবহ সময় অতিক্রম করছি, যা কারবালার বন্দিশিবিরের কুফায় আগমন এবং বহু বর্ণনায় ১২ই মহররমে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শাহাদতের স্মরণে আবৃত। সেই মহামানব, যিনি তাঁর অত্যাচারিত ফুফু হযরত জয়নাব (সা.)-এর সঙ্গে মিলিতভাবে আশুরার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। এই পটভূমিতেই "জিহাদে তাবিয়িন" (সত্য ব্যাখ্যার সংগ্রাম) আমাদের জন্য এক অনন্য শিক্ষা হয়ে রয়ে গেছে।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও জিহাদে তাবিয়িনের পথ
হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলেমিন ড. মোহাম্মদ জেদারি আলি বলেন, ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর আন্দোলনের পদ্ধতির কেন্দ্রে ছিল "জিহাদে তাবিয়িন"। তিনি একদিকে তখনকার শাসক শ্রেণি কর্তৃক ইমাম হুসাইন (আ.) ও আহলে বাইতের বিরুদ্ধে ছড়ানো অপপ্রচারের জবাব দিতেন, অন্যদিকে ইসলাম, নবী (সা.) ও আহলে বাইতের প্রকৃত আদর্শ ও স্বাধীনতা-সংগ্রামের দর্শন তুলে ধরতেন—তা-ও এক নির্যাতনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে, যা সত্য উচ্চারণকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল।

কুফা ও শামে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ
কারবালার পরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে তাঁর ভাষণ। কুফার ভাষণে তিনি কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন, “যদি হুসাইন (আ.) শহীদ হন, তবে তা অবাক হওয়ার কিছু নয়, কারণ তাঁর পিতা, যিনি মানবতার শিরোমণি ছিলেন, তাকেও শহীদ করা হয়েছিল। হে কুফাবাসী! তোমরা যা করেছ, তাতে গর্বিত হয়ো না। এটি এক ভয়ংকর ঘটনা! আমার প্রাণ কুরবান হোক তাঁর জন্য, যিনি ফোরাত নদীর তীরে শহীদ হন। জাহান্নামের আগুন অপেক্ষা করছে তাঁর হত্যাকারীদের জন্য।”

তিনি জনগণকে প্রতিশোধ বা সাহায্যের আহ্বান না জানিয়ে বলেন, “তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো না, অন্তত আমাদের পাশে থেকো না।” এ ছিল নিঃস্বার্থ আদর্শিক অবস্থান।

শামে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর জাগরণমূলক কৌশল
শামে এক রাজনৈতিক চক্রান্তে ইমাম সাজ্জাদ (আ.), হযরত জয়নাব (সা.আ.) ও আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যদের বেঁধে নিয়ে আসা হয়। সেই সভায় এক বক্তা ইয়াজিদ ও তার পূর্বপুরুষদের প্রশংসা ও হযরত আলী (আ.)-এর নিন্দা করছিল। তখন ইমাম বলেন, “ধ্বংস হোক তুমি! তুমি এক দাসের সন্তুষ্টি লাভের জন্য আল্লাহর ক্রোধকে ডাকছো—তোমার পরিণাম আগুনের শাস্তি।”

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এরপর নিজে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি চান। শামী জনগণের জোরাজুরিতে ইয়াজিদ অবশেষে সম্মতি দেন। এই ভাষণে ইমাম তাঁর বংশের পরিচয় তুলে ধরেন: তিনি ছিলেন নবী (সা.)-এর প্রপৌত্র, হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (সা.আ.)-এর সন্তান। তিনি বলেন, তাঁর পিতা হুসাইন (আ.) বিদ্রোহী বা ফিতনাকারী নন, বরং আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে প্রেরিত এক ইমাম।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর বক্তব্যে শামীদের প্রতিক্রিয়া
এই ভাষণ ইয়াজিদের ভিত্তি কাঁপিয়ে তোলে। আতঙ্কে ইয়াজিদ আদেশ দেন আজান দেওয়ার, যাতে ইমামের কথা থেমে যায়। কিন্তু মুয়াজ্জিন যখন বলেন: "আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ", তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন, “হে ইয়াজিদ! বলো, এই মুহাম্মদ কি তোমার পূর্বপুরুষ, না আমার? যদি বলো তোমার, তবে মিথ্যা বলছো। আর যদি আমার হন, তবে বলো কেন তাঁর আহলে বাইতকে হত্যা করলে?”

এই জিজ্ঞাসা সভার পরিবেশ বদলে দেয়। মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ে। অনেকে সভা ত্যাগ করে, কেউ কেউ তওবা করে। এমনকি ইয়াজিদও ভয়ে নামাজ না পড়ে সভা ত্যাগ করে।

এক ঘোর অন্ধকারে আলো হয়ে জিহাদে তাবিয়িন
নারজেস শোকরজাদেহ, হাওযা ইলমিয়ার গবেষক বলেন, “ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-কে সত্য প্রচারের জিহাদের পুরোধা হিসেবে দেখা উচিত। তিনি এক চরম নিপীড়ন ও বিভ্রান্তিকর পরিবেশে সত্যের আলো জ্বালাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “কারবালার পর শত্রুরা জনগণের মন-মানসিকতাকে ঘোলাটে করে তোলে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু ইমাম সাজ্জাদ (আ.) নিরবিচারে দোয়া, মুনাজাত ও ভাষণের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেন এবং অন্তরে চিন্তার জাগরণ ঘটান।”

ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর জিহাদে তাবিয়িনের পদ্ধতিসমূহ
তিনি দোয়া, মুনাজাত, রোজার মজলিস ও বক্তব্যের মাধ্যমে জিহাদে তাবিয়িনকে অব্যাহত রাখেন। কঠোর সেন্সরের মধ্যে তিনি দোয়ার ভাষায় সত্য বলতেন। এভাবে তিনি মানুষকে কোরআন ও নববী আদর্শের পথে ফিরিয়ে আনেন।

শেষে নারজেস শোকরজাদেহ বলেন, “দুশমন ভেবেছিল আশুরা দিয়ে সব শেষ হবে। কিন্তু ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও বুদ্ধিদীপ্ত তাবিয়িন শত্রুর সকল ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়। এই জিহাদ আজও আমাদের পথ দেখায়।”

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ছিলেন শুধু কারবালার উত্তরাধিকারী নয়, বরং এক জীবন্ত ব্যাখ্যাকারী, যিনি নিরবিচারে ও কৌশলীভাবে 'জিহাদে তাবিয়িন' চালিয়ে গেছেন। তাঁর দোয়া, ভাষণ ও বিপ্লবী অবস্থান চিরকালীন আদর্শ হয়ে থাকবে, বিশেষত এই যুগে—যখন সত্যকে গলাটিপে হত্যা করা হয়, তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর তাবিয়িন আমাদের পথ দেখায়।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha