হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আরবাঈনের দিনটি ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শাহাদতের স্মরণে পালন করা হয়, যাঁকে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী নির্মমভাবে শহীদ করে।
ইমাম হুসাইনের সমাধিস্থলের দিকে পদযাত্রা মানে সেই সত্য ও ন্যায়ের প্রতীকের দিকে যাত্রা, যে অত্যাচার ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিলেন। এই পদযাত্রা আমাদের ঈমানকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কতটা জরুরি।
একজন শহীদ শিক্ষাদাতা হন, যাঁর শাহাদত ও মজলুমিয়ত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক জীবন্ত বার্তা। যে শহীদ তার রক্তের জোশে ইতিহাসের ধারার সাথে সাথে প্রবাহিত হতে থাকে সেই শহীদ শিক্ষা ও আদর্শের প্রতীক হয়। আর তাঁর রক্ত ইতিহাসের স্রোতে চিরকাল বহমান থাকে। কোনো জাতির মজলুমিয়ত তখনই সঠিক স্বীকৃতি পায়, যখন সেই মজলুমিয়ত একটি উচ্চস্বরে পরিণত হয় এবং সেই কণ্ঠস্বর বিশ্বমানবের কর্ণগোচর হয়।
এই কারণে আজকের বিশ্বে পরাশক্তিগুলি চায় না যে, আমাদের কণ্ঠস্বর প্রভাব বিস্তার করুক। তারা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে প্রস্তুত, শুধু এই বার্তাটি গোপন রাখতে যে, কারবালার যুদ্ধ কেন সংঘটিত
হয়েছিল এবং তার পেছনে কী আদর্শিক প্রেরণা কাজ করেছিল। অতীতের ঔপনিবেশিক শক্তিরাও এই সত্য চাপা দিতে তৎপর ছিল, যাতে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর রক্ত ও শাহাদতের বার্তা জনগণের হৃদয়ে না পৌঁছায়। এই যুগেও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো প্রস্তুত ছিল যত অর্থই লাগুক, তারা চেয়েছিল যেন হুসাইন (আঃ)-এর নাম ও স্মৃতি এবং আশুরার শাহাদাত মানুষের মনে একটি শিক্ষা হিসেবে গেঁথে না যায়। শুরুতে তারা বুঝতে পারেনি যে, বিষয়টি কত মহান ও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সময় যতই গড়াতে থাকে, মানুষ ধীরে ধীরে তা আরও গভীরভাবে বুঝতে থাকে।
বনু আব্বাসের খিলাফতের সময় ইমাম হুসাইনের (আঃ)-এর পবিত্র কবরও ধ্বংস করে ফেলা হয়, তাঁর রওযা পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা।
কিন্তু শাহাদতের স্মরণ করার মধ্যে রয়েছে এক বিপুল শক্তি। কারণ শহীদের রক্ত তখনই প্রভাব ফেলে, যখন তা হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাঁর স্মৃতি তরতাজা থাকে। আর আরবাঈনের দিনটি সেই দিন, যেদিন প্রথমবার কারবালার শাহাদাতের বার্তার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এটি শহীদদের উত্তরসূরিদের দিন। আরবাঈন সেই ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়, যখন কারবালার বার্তা প্রথমবারের মতো সার্বজনীনভাবে উচ্চারিত হয়।
আরবাঈন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, শহাদাতের সত্যিকারের মানে ও উদ্দেশ্যকে শত্রুদের প্রচার-প্রচারণার ঝড়ের মুখেও জীবিত রাখা উচিত। যদিও সেই প্রচার ও ঝড় এমন একটি যুদ্ধের বিরুদ্ধেই চালানো হয়েছিল, যে যুদ্ধ ছিল মানুষের সম্মান, মর্যাদা, দেশ ও ইসলামের রক্ষা এবং তাদের প্রতিরক্ষার জন্য।
ইয়াজিদের জালেম শাসন ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আঃ)-কে তার প্রচারণার মাধ্যমে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করে। আর তারা (শত্রুরা) মানুষকে এই বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল যে, ইমাম হুসাইন (আঃ) এমন একজন ব্যক্তি যিনি ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে দুনিয়ার লোভে বিদ্রোহ করেছেন। কিছু মানুষ এই মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাসও করে। কিন্তু যখন হুসাইন ইবনে আলী (আঃ)-কে কারবালার মরুভূমিতে অদ্ভুত অবস্থা ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে জালেম দ্বারা শহীদ করা হয়, তখন তারা এটিকে নিজেদের বিজয় ও সাফল্য হিসেবে উদযাপন করে। তবে ইমামতের তবলিগী ঐ সমস্ত অপবাদ ও ষড়যন্ত্রকে পাল্টে দিল এবং প্রমাণ করে দিল, সত্যকে কখনোই মিথ্যা ষড়যন্ত্র ও অপবাদের মাধ্যমে দমন বা লুকানো যায় না।
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) একদিকে যেমন ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর হত্যাকারীদের প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তেমনি ধাপে ধাপে গোমরাহির (ভ্রান্তির) পথও বর্ণনা করে দিয়েছেন, যেন কিয়ামত পর্যন্ত হিদায়াত ও সৌভাগ্যের পথে চলতে ইচ্ছুক মানুষ সতর্ক থাকে।
প্রথমে দুনিয়ার মোহ, তারপর আখেরাত বিকিয়ে দেওয়া, এরপর নফসের খাহেশ পূরণ এবং শেষত: আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) ও ইমাম (আঃ)-এর অসন্তুষ্টির দিকে ধাবিত হওয়া।...মানুষকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
ইমাম হুসাইন (আঃ) ভ্রান্তপথে চলা লোকদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে জিহাদ করেন। এমনকি সেই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যেখানে তাঁর রক্ত ঝরানো হয় এবং তাঁর পবিত্রতা লঙ্ঘন করা হয়।
এটি এই জন্য ছিল, যাতে দুনিয়া বুঝতে পারে যে জিহাদ মানে ধৈর্য ছেড়ে দেওয়া নয় বরং জিহাদ মানে হলো ধৈর্যধারণ করে নিজের হক ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করা।
হুসাইনী প্রেমের আগুন কখনও নিভে যাবে না। আরবাঈনের দিনে পদযাত্রীদের বিশাল সমাবেশ দেখে উদ্বেগ এই কারণে হয় যে, এতে বনু উমাইয়া-র অত্যাচারের মুখোশ খুলে যায়। তাদের জুলুম প্রকাশ্যে আসে, আর প্রতিটি যুগের বাতিল ও জালিম শক্তিগুলো নিজেদের শাসনের পতনের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
আজকের যুগে এই বিশাল আরবাঈন যাত্রা এক নিদর্শন হয়ে উঠেছে, যা মুসলিম ও মানব সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা’র ভাষায় :
"আরবাঈনের এই মহাসমাবেশ বর্তমানে ইসলামী বিশ্বের একটি নিদর্শন ও প্রতীকতে পরিণত হয়েছে, যা বাস্তবে জুলুমের বিরুদ্ধ চেতনা এবং মুসলিম ও মানব সমাজে জাগরণ ও সচেতনতার দিকটি উন্মোচন করছে। এটি এমন একটি উপযুক্ত সুযোগ, যাতে মানুষ প্রতিবছর ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর প্রতি তাদের প্রেম ও ভালোবাসার আবেগকে নবায়ন করতে পারে এবং আরবাঈনকে প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় আরও গভীর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক ভক্তির সাথে পালন করে।
এটি কারবালার শহীদগণ এবং শহীদদের শ্রেষ্ঠ নেতা ইমাম হুসাইন (আঃ) বার্তা জীবিত ও দীপ্তিময় রাখার জন্য প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বস্ততা পুনর্নবীকরণের দিন।"
নিশ্চয়ই এই হুসাইনী অঙ্গীকারের নবায়ন শুধু ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর বার্তাকে জীবিত রাখার মাধ্যম নয়, বরং হুসাইনী সমাজের মূল ভিত্তিগুলোকেও বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
তবে এর জন্য কেবল এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন এই যে, আমরা একবার তাকিয়ে দেখি সেই ৬১ হিজরির কারবালার দিকে এবং সেই আন্দোলনের বার্তাকে আমাদের অস্তিত্বের গভীরে উপলব্ধি করি, যা ইমাম হুসাইন (আঃ) আমাদের পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।
এর জন্য প্রয়োজন কারবালার পৃষ্ঠাগুলো উল্টে দেখা এবং তা উপলব্ধির করা।
যদিও সায়্যিদুশ্ শুহাদা (আঃ)-এর আন্দোলনে আপনি এমন বহু উপাদান খুঁজে পাবেন, যা এই আন্দোলনের ভিত্তি ও মৌল কাঠামো গঠনে ভূমিকা রেখেছে, যেমন :
— আল্লাহর বন্দেগী
— ন্যায় ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা
— জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
কারবালার এই আন্দোলনে যুক্তি ও বোধগম্যতার দিকটি পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়। যদি আমরা ইমাম (আঃ)-এর বক্তব্য ও উক্তিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাই যে, মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত এবং কারবালায় পৌঁছানোর পর শহীদ হওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত — একটি সুদৃঢ় ও স্থায়ী যুক্তিবোধ সক্রিয় ছিল।
এই যুক্তির সারকথা হলো : যখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, ইয়াজিদের মতো একজন শাসক মুসলিম উম্মাহর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হয়ে যায় যে, তারা নিজেদের দায়িত্ব চিনে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
তাই যদি কোনো বিপদের আশঙ্কাও থাকে তবু একজন মানুষ বিপদ দেখে পিছিয়ে না পড়ে বরং এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা সেই বিপদের মোকাবিলার উপযুক্ত ও সম্মানজনক হয়।
এমন পরিস্থিতিতে একথা স্পষ্ট একজন মানুষ এমনভাবে এগিয়ে যায় যে দুনিয়া তাকে থামাতে না পারে, তার লালসা ও কামনা-বাসনা তার পায়ে শৃঙ্খল পরাতে না পারে, তার স্বাচ্ছন্দ্যপ্রবণতা ও কূটনীতি যেন তার গতি মন্থর না করে ফেলে।
এই কারণেই ইমাম (আঃ) স্পষ্টভাবে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ঘোষণা করেন এবং বলেন:
"যদি কেউ এমন এক জালিম শাসককে দেখে, যে আল্লাহর হারামকে হালাল করেছে, আল্লাহর অঙ্গীকার ভেঙেছে, রাসূল আল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নতের বিরোধিতা করেছে, এবং আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জুলুম করছে — অথচ সেই ব্যক্তি তার কথা ও কাজের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়, তবে আল্লাহর জন্য উপযুক্ত হয় যে, তাকেও সেই জালিম শাসকের স্থানেই স্থাপন করা হোক।"
এই নূরানী (আলোকিত) বাণীগুলোর মাধ্যমে ইমাম (আঃ) সমাজকে এই দিকেই সচেতন করতে চেয়েছেন — যে যখন দ্বীনের মূল ভিত্তি ও কাঠামো বিপদের মুখে পড়ে, আর তখনো যদি মানুষ নিজের স্বার্থ ও ব্যস্ততায় লিপ্ত থাকে, তাহলে এটা আল্লাহর অধিকার হয়ে যায় যে, এমন সময়ে বেঁচে থাকা দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিদের হিসাব নিকাশের আওতায় এনে কঠোর আজাব তথা ক্রোধ নিক্ষেপ করা।
ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর শাহাদাতকে জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়, আর আরবাঈনের দিনটি তাঁর ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার এবং জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দিন।
আরবাঈনের এই দিন আমাদের এই বার্তা দেয় যে, আমাদের সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত, জুলুম ও অন্যায়ের মোকাবিলা করা উচিত এবং আমাদের বিশ্বাস ও আকিদায় দৃঢ় থাকা উচিত।
আরবাঈনের দিন সেই আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং যুগে যুগে জালিমদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শপথ নেওয়ার দিন।
আরবাঈনের মহাসমাবেশ এই মুহূর্তে ইসলামি জগতের একটি নিদর্শন ও প্রতীক হিসেবে পরিণত হয়েছে, যা বাস্তবিক অর্থে মানব সমাজ ও মুসলমানদের মধ্যে জুলুমের বিরুদ্ধ লড়াই এবং জাগরণকে প্রকাশ করছে।
আল্লাহ সবাইকে সত্যের পথে অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন এবং আরবাঈনের আধ্যাত্মিক প্রভাবকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের শক্তি দিন।
লেখা: হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মাসুম আলি গাজী নাজাফি
আপনার কমেন্ট