হাওজা নিউজ এজেন্সি: যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং গবেষণাগারে রচিত হয়েছিল প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ— এই প্রতিবেদন উন্মোচন করা হল সেই অজানা অধ্যায়:
যে প্রযুক্তি শুরু হয়েছিল আত্মত্যাগ দিয়ে
দুই দশক আগেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে ইরান, একসময় অস্ত্র আমদানিতে পরনির্ভর একটি রাষ্ট্র, আজ পশ্চিম এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী মিসাইল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে।
এই অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল এক বিপন্ন সময়ের এক অসাধারণ সিদ্ধান্ত দিয়ে—যেখানে অস্ত্র ছোঁড়ার বদলে তা খুলে ফেলা হয়েছিল গবেষণাগারে পাঠানোর জন্য।
১৯৮৪: যুদ্ধ, অবরোধ ও এক বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি
সাল ১৯৮৪। ইরান-ইরাক যুদ্ধ চরমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান অস্ত্রশূন্য ও বিশ্বব্যবস্থায় একঘরে। বর্তমান আরব দেশগুলোর মতো ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তখন পুরোপুরি আমদানিনির্ভর।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে লিবিয়া থেকে ৩০টি স্কাড-টাইপ মিসাইল সংগ্রহ করে ইরান। যুদ্ধের ময়দানে এগুলো ছিল জীবনরক্ষা করার মতো অস্ত্র। কিন্তু তখন ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন আলেম, যিনি শুধু প্রশাসক ছিলেন না—তিনি ছিলেন মাঠের মানুষ, সামরিক পোশাক পরিহিত মুজাহিদ, সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী।
তিনি একটি বিস্ময়কর নির্দেশ দেন, “এই মিসাইলগুলোর মধ্যে দুটি সরিয়ে ফেলো। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করো।”
মাঠে যুদ্ধ, গবেষণাগারে ভবিষ্যত
এই নির্দেশে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC)-এর অনেকেই বিস্মিত হন। তারা বিনয়ের সাথে বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিটি অস্ত্র অমূল্য। এখন এগুলো গবেষণার জন্য সরিয়ে রাখা মানে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু খামেনেয়ী অনড় ছিলেন। “যদি এখনই না সরাও, তাহলে সেগুলো যুদ্ধে খরচ হয়ে যাবে, আর আমরা কখনো শিখতে পারব না।”
শুধু তাই নয়, তিনি সস্তায় মিসাইল কেনার একটি সুযোগও বন্ধ করে দেন। কারণ, তার মতে— “আমরা যদি এই অর্থ দিয়ে নিজেরাই একটি মিসাইল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না তুলি, তাহলে চিরকাল পরনির্ভর থাকব।”
অস্ত্র নয়, স্বাধীনতা ছিল মূল লক্ষ্য
এই সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্তরে অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ। যুদ্ধের মুহূর্তে কেউ অস্ত্র ছাড়ে না, কেউ গবেষণা করে না। কিন্তু খামেনেয়ী জানতেন, “মুহূর্তের জয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভবিষ্যতের প্রস্তুতি।”
আজ ৪১ বছর পর আমরা সেই সিদ্ধান্তের ফল দেখতে পাচ্ছি— ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে ‘শাবাব', ‘খালিজ ফারস’, ‘জুলফিকার’, ‘গাজ়নভী’, ‘খুররামশাহার’, ‘খায়বার শেকান’ সহ শতাধিক ধরনের মিসাইল।
২০২৪ ও চলমান বছরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে “True Promise” নামক প্রতিরোধ অভিযানে ইরানের মিসাইল শিল্প তার বাস্তব শক্তির জানান দিয়েছে।
দ্বিতীয় এক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত: হিজবুল্লাহকে ঘিরে রণকৌশল
১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালায়। IRGC-র একদল সদস্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খোমেনীর কাছে যান। তারা লেবাননে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধ করার অনুমতি চান।
ইমাম খোমেনী বললেন, “না। তারা আমাদের জন্য একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে চায়, যাতে আমরা উভয় ফ্রন্টে পরাজিত হই; বরং তোমরা তাদের প্রশিক্ষণ দাও।”
এই ‘না’-এর মধ্যেই ছিল ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি। হিজবুল্লাহকে প্রশিক্ষণ দেয় ইরানি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। পরবর্তীতে হিজবুল্লাহ পরিণত হয় ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধের এক অপ্রতিরোধ্য ফ্রন্টে।
আজকের বাস্তবতা: ইমামদের দূরদর্শিতার ফল
আজ যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, “আমরা সাতটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করছি,” তখন বিশ্বের চোখ খুলে যায়—এই সাতটি ফ্রন্টের ভিত্তি রেখেছিলেন ইমাম খোমেনী ও আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বহু দশক আগে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ, ইরাকের হাশদ আশ্-শাবি, সিরিয়ার প্রতিরোধ দল, আফগানিস্তানের ফাতেমিয়ুন এবং পাকিস্তানের জায়নাবিয়ুন—সবগুলোই সেই “অক্ষ-এ-মুকাওয়ামাত” (Axis of Resistance)-এর ফলাফল।
সারসংক্ষেপ: প্রযুক্তি, ত্যাগ ও ঐক্যের বিপ্লব
ইরান যে আজ মিসাইল সুপারপাওয়ার, তা শুধু একটি সামরিক অর্জন নয়; এটি একটি চিন্তা-পদ্ধতির বিজয়। যুদ্ধ চলাকালে অস্ত্র ছুঁড়ে না মেরে তা খুলে গবেষণাগারে পাঠানো—এ এক দৃষ্টান্ত, যেখানে ঈমান, দূরদৃষ্টি ও আত্মনির্ভরতাই ছিল আসল অস্ত্র।
শেষকথা: “যারা সময়ের আগে ভাবতে শেখে, তারাই ইতিহাস গড়ে। যারা নিজেরাই অস্ত্র বানায়, তারাই একদিন অন্যের আগ্রাসন প্রতিহত করে।”
আপনার কমেন্ট