মঙ্গলবার ৫ আগস্ট ২০২৫ - ১৯:৪৮
আরবাঈনের নীরবতা: পশ্চিমা গণমাধ্যম কীসের ভয়ে চুপ?

বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কোটি যিয়ারতকারি পায়ে হেঁটে কারবালার উদ্দেশে যাত্রা করছেন আরবাঈন উপলক্ষে — এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশ। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমে এই বিরল আধ্যাত্মিক ঘটনাটি নিয়ে নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ষাঁড়ের লড়াই, টমেটো ছোঁড়ার উৎসব বা ফুটবল ম্যাচের মতো তুলনামূলক ছোট আয়োজনেরও সরাসরি সম্প্রচার হয়, সেখানে আরবাঈনের মতো অভূতপূর্ব এক মানবিক ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: প্রশ্ন জাগে — কেন এই নীরবতা? কেন এই ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা? সম্ভবত এর উত্তর নিহিত আছে আশুরা ও আরবাঈনের অন্তর্নিহিত বার্তায়। ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর বিপ্লব ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জুলুম ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক চিরন্তন প্রতিরোধ।
তাঁর সেই হৃদয়বিদারক আহ্বান — "হাল মিন নাসিরিন ইয়ানসুরুনা?" — “কেউ কি আছেন, আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন?” — কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং এটি এক অবিনাশী নৈতিক আহ্বান, যা সময়ের সীমানা পেরিয়ে মানবতা ও বিবেককে জাগিয়ে তোলে।

এই বার্তা শক্তিশালী। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগ ও ন্যায়বিচারের ডাক দেয়। আর ঠিক এখানেই এটি অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে বর্তমান বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোর জন্য — যেখানে শোষণ ও আধিপত্যই অনেক সময় প্রগতির নাম হয়ে দাঁড়ায়।

আরবাঈন কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয় — এটি “আল্লাহর বেলায়াত” বা তাঁর অভিভাবকত্বের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। এই মহাযাত্রা ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের অন্তরকে এক করে — যেখানে শিয়া মুসলমানদের পাশাপাশি খ্রিস্টান, ইহুদি, এমনকি জরথুস্ত্রবাদীরাও অংশ নেন।

এই যাত্রার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো: নিঃস্বার্থ সেবা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। কোথাও কোনো বাণিজ্যিক বিনিময় নেই; বরং যিয়ারতকারি জন্য খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা — সবই দেওয়া হয় বিনা মূল্যে, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এই আত্মত্যাগ ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি পুঁজিবাদী ভোগবাদকে একেবারে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এটি দেখায়, মানুষের জন্যে ভালোবাসা ও সেবাই পারে একটি সমাজকে এক করতে — বিনিময়ের প্রয়োজন হয় না।

আরবাঈন শুধু অতীত স্মরণ নয়; এটি ভবিষ্যতের এক প্রত্যাশাও — ইমাম মাহদী (আঃ)-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এক ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি।
যেখানে অন্যায়ের স্থান নেই, লোভের জায়গা নেই; থাকবে কেবল সুবিচার, সেবা, ও আল্লাহর নির্দেশিত পথ।

এমন এক ভাবাদর্শিক আন্দোলন, যা বিভাজন নয়, ঐক্য ও মানবতা গড়ে তোলে — তা হয়তো আধিপত্যবাদী মিডিয়া কাঠামোর জন্য ভীতিকর।

কিন্তু গণমাধ্যমের নীরবতা এই সত্যকে থামাতে পারেনি। বরং প্রতিবছর এই যাত্রায় অংশগ্রহণ আরও বাড়ছে। জাতি, ভাষা, মতপার্থক্য পেরিয়ে মানুষ এক হচ্ছেন কারবালার পতাকা তলে।

যারা এই বার্তাকে স্তব্ধ করতে চায়, তাদের উদ্দেশে আল-কুরআনের ঘোষণা: “তারা চায় আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে নিজেদের মুখের ফুৎকারে; কিন্তু আল্লাহ তাঁর আলো পূর্ণ করেই ছাড়বেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আত-তাওবা, ৯:৩২)

আরবাঈন কেবল দেখা যায় না — এটি অনুভব করা যায়। এই যাত্রা একটি আলোকবর্তিকা — এক এমন সময়ের জন্য, যেখানে বিভাজন, হিংসা ও ভোগবাদ বিশ্বজুড়ে অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha