হাওজা নিউজ এজেন্সি: সোমবার ইয়েমেনি নৌবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, ‘সাইয়্যাদ’ ক্ষেপণাস্ত্রটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় অভিযানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এটি ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লার, চলমান লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে এবং অত্যাধুনিক রাডার-এড়ানো প্রযুক্তিতে সজ্জিত।
বিবৃতিতে বলা হয়, ক্ষেপণাস্ত্রটি ইয়েমেনের যেকোনো ভূখণ্ড থেকে উৎক্ষেপণ করে শত্রু জাহাজগুলোকে লোহিত সাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।
এই অস্ত্রের সংযোজন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের শত্রু তৎপরতার বিরুদ্ধে ইয়েমেনের প্রতিরোধ কৌশলে কৌশলগত এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সানার আল-সাবিন স্কয়ারে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে ‘সাইয়্যাদ’ প্রথমবার প্রদর্শিত হয়।
সে সময় জানানো হয়েছিল, এটি কঠিন জ্বালানি চালিত বুস্টার ব্যবহার করে এবং মাঝারি পাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে যথেষ্ট বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আঘাত হানতে পারে।
প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতা
‘সাইয়্যাদ’ (আরবি শব্দ, অর্থ: শিকারি) হল ইয়েমেনের নৌবাহিনীর সর্বশেষ সংযোজন, যা মূলত রেড সি অঞ্চলে ইসরায়েলি ও মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০১৫ সালের পর থেকে ইয়েমেন তার অস্ত্র ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করে। সাইয়্যাদ হলো এ উন্নয়নের ফলাফল, যার পাল্লা প্রায় ৮০০–১,০০০ কিলোমিটার, যা লোহিত সাগরের ৮০ শতাংশ, গালফ অব এডেন এবং ভারত মহাসাগরের একাংশকে কাভার করতে সক্ষম।
যদিও এটি অধিকৃত ফিলিস্তিন পর্যন্ত পৌঁছায় না, তথাপিও শত্রুর নৌবহর, যেগুলো সাধারণত ইয়েমেন থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে, তাদের জন্য এটি যথেষ্ট হুমকি।
ক্ষেপণাস্ত্রটি স্যাটেলাইট ও ইনারশিয়াল গাইডেন্স প্রযুক্তিতে পরিচালিত, যার সাহায্যে এটি স্থল ও সমুদ্র—উভয় ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। রেড সি-তে সাম্প্রতিক ইসরায়েল-সম্পৃক্ত বাণিজ্যিক জাহাজে আঘাত এর প্রমাণ বহন করে।
‘সাইয়্যাদ’ ক্ষেপণাস্ত্রের দৈর্ঘ্য ৬.৮ মিটার, প্রস্থ ০.৫ মিটার এবং এতে ২০০–৩০০ কেজি বিস্ফোরকবাহী ওয়ারহেড থাকে, যা সামরিক ঘাঁটি, যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজ ধ্বংসে সক্ষম।
এটি মোবাইল স্থলভিত্তিক লঞ্চার থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য হলেও সাম্প্রতিক ঘোষণায় সমুদ্রপথ থেকে উৎক্ষেপণের সংস্করণ উন্নয়নাধীন বলে জানানো হয়েছে। সাগর থেকে উৎক্ষেপণের ফলে এর কভারেজ রেঞ্জ আরও বাড়বে, যা লাল সাগর ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের অংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে।
এটি সাবসনিক গতি (মাচ ০.৭–০.৯) এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের অতি নিচ দিয়ে উড়ে চলতে পারে, ফলে শত্রুর রাডার সিস্টেমে শনাক্ত করা কঠিন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সময়ও সীমিত।
ইরানি ‘কাদির-৩৮০’ এবং ‘পায়েভ’ ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে এর নকশাগত মিল রয়েছে। বিশেষ করে ‘কাদির-৩৮০’ ১,০০০ কিমি’র বেশি পাল্লার, ইলেকট্রনিক জ্যামিং প্রতিরোধী এবং ট্রাক-মাউন্টেড র্যাম্প লঞ্চার থেকে মাত্র ৫ মিনিটের প্রস্তুতিতে উৎক্ষেপণযোগ্য।
ইয়েমেনের অস্ত্রভাণ্ডারে সাইয়্যাদ-এর কৌশলগত গুরুত্ব
সৌদি আগ্রাসনের পর ইয়েমেনের ‘আনসারুল্লাহ’ প্রতিরোধ আন্দোলনের হাত ধরে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। সোভিয়েত যুগের অস্ত্রে নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে ২০১৭ সালে ‘কুদস-১’ চালুর মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন শুরু হয়।
৭০০–১,০০০ কিমি পাল্লার এই সাবসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি জিপিএস/ইনারশিয়াল গাইডেন্সে পরিচালিত এবং তেল স্থাপনা ও শিপিং ভেসেলে ব্যবহৃত হয়েছে।
এরপর ‘সাম্মাদ’ সিরিজ—‘সাম্মাদ-২’ ও ‘সাম্মাদ-৩’—প্রবর্তিত হয় ২০১৮–২০১৯ সালে। এগুলোর পাল্লা ছিল ৩০০–৬০০ কিমি। প্রাথমিকভাবে এগুলো শত্রু ঘাঁটিতে আঘাতের জন্য ব্যবহার হয়।
সা’দা ও সানায় অবস্থিত ভূগর্ভস্থ কারখানায় এসব ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদিত হচ্ছে। ধারণা করা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে ইয়েমেনের কাছে প্রায় ১০০–১৫০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ রয়েছে।
সাইয়্যাদ হলো একটি অত্যাধুনিক, দীর্ঘপাল্লার এবং রাডার-এড়াতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইয়েমেনের বিদ্যমান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন অস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী।
অন্যদিকে, কামিকাজি ড্রোনগুলো সাধারণত ২০–৫০ কেজি ওয়ারহেড বহন করে, যা সীমিত ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে, কিন্তু সাইয়্যাদ ২০০–৩০০ কেজি ওয়ারহেড নিয়ে একটি শত্রু যুদ্ধজাহাজকে ধ্বংস বা অকার্যকর করে দিতে পারে।
যদিও ইয়েমেনের বিদ্যমান অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও শক্তিশালী, তবে তাদের পাল্লা সাইয়্যাদের তুলনায় প্রায় ৩–৫ গুণ কম।
‘সাইয়্যাদ’ ক্ষেপণাস্ত্রের সংযোজন ইয়েমেনকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এক নতুন অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এর দীর্ঘপাল্লা, সমুদ্রপৃষ্ঠঘেঁষা গতি, রাডার প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিধ্বংসী ওয়ারহেডের সংমিশ্রণে এটি এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং তাদের মিত্রদের জন্য একটি বাস্তব ও তাৎপর্যপূর্ণ হুমকি।
আপনার কমেন্ট