হাওজা নিউজ এজেন্সি: ২৩ রবিউল আউয়াল, হযরত ফাতিমা মাসূমা (সা.আ.)-এর কোম নগরীতে আগমনের বরকতময় বার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি যে, তাঁর এ স্বল্প উপস্থিতি ইরানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তাঁর পবিত্র সমাধির বরকতে কোম আহলে বাইতের (আ.) ইলমি ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং শিয়াত্ব বিস্তারে মৌলিক ভূমিকা পালন করে।
ইরানে শিয়াত্ব বিস্তারে হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর ভূমিকা
হযরত ফাতিমা মাসূমা (সা.আ.)-এর মদীনা থেকে কোমে হিজরত ইরানের শিয়াত্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। যদিও তিনি কোমে মাত্র সতেরো দিন অবস্থান করেছিলেন, কিন্তু তাঁর বরকতময় উপস্থিতি এবং পরবর্তীতে তাঁর দাফন কোমকে শিয়াদের ইলমি ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র বানিয়ে তোলে। এ শহর পরবর্তীতে “উম্মুল কুরা-এ শিয়া” (শিয়াদের রাজধানী) নামে খ্যাত হয়।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিজরত
হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর হিজরত দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় হিজরি শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শিয়াদের ধারাবাহিক হিজরতগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ হিজরত ইমাম রেজা (আ.)-এর হিজরতের মতোই ইরানের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মানচিত্রে গভীর পরিবর্তন আনে এবং এ দেশ ধীরে ধীরে আহলে বাইতের (আ.) শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হয় [১, ২, ৩]।
কোম নগরী: শিয়াত্বের স্পন্দিত হৃদয়
হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর পবিত্র সমাধির বরকতে কোম অতি দ্রুত মুমিনদের আশ্রয়স্থল ও আলেম ও মুহাদ্দিসদের নিরাপদ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইমামগণ (আ.)-এর পক্ষ থেকে তাঁর জিয়ারতের ব্যাপারে বারবার সুপারিশ তাঁর মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। যেমন:
“যে-ই আমার কন্যাকে কোম শহরে জিয়ারত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে।”
“যে-ই আমার বোনকে কোম শহরে জিয়ারত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে।”
“যে-ই আমাদের ফুফুকে কুম শহরে জিয়ারত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে।”
এই ফজিলতসমূহ শিয়াদের কোমমুখী করে তোলে এবং অনেকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফলস্বরূপ কোম দ্রুতই ইসলামের অন্যতম জনবহুল শহর ও শিয়াত্বের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয় [৪, ৫]।
ষষ্ঠ হিজরি শতকে রাযি কাজভিনি লিখেছেন, “হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর মাজারে সাধারণ মানুষ যেমন যায়, তেমনি হানাফি ও শাফেয়ি মাজহাবের রাজা-আমিররাও সেখানে উপস্থিত হয়ে তাওয়াসুল কামনা করে” [৬]। চতুর্থ হিজরি শতকের উৎসগুলোতেও রেই শহরসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের তাঁর জিয়ারতে আগমনের উল্লেখ পাওয়া যায় [৭]।
জিবাল অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর ওপর কোমের প্রভাব
ঐতিহাসিক সূত্রে “জিবাল” বলা হতো এক বিশাল অঞ্চলকে, যেখানে ইসফাহান, জান্জান, কাজভিন, হামেদান, দিনাওর, রেই ও কেরমানশাহর মতো শহর অন্তর্ভুক্ত ছিল [১১]। এ অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত কোম, হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর সমাধিকে কেন্দ্র করে শিয়া শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে আশেপাশের শহরগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে।
ইতিহাসবিদদের মতে, রেই ও কাশান শহরে শিয়াত্ব বিস্তার ব্যাপকভাবে কোম ও তার আলেমদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল [৮, ৯, ১০]।
বণিক, যাত্রী, জিয়ারতকারী ও জ্ঞানপিপাসুদের যাতায়াত কোমের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। এমনকি ভৌগোলিকভাবে কোমের প্রভাবাধীন নয় এমন শহর, যেমন কেরমানের কিছু অংশও এই শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে শিয়াত্ব গ্রহণ করে।
আশআরিদের ভূমিকা ও কোমের মুহাদ্দিসগণ
এ সময় কোমে আশআরি পরিবার বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তারা সরাসরি ইমামগণের (আ.) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত [১২]। শত শত মুহাদ্দিস ও আহলে বাইতের শাগরিদ এখানে অবস্থান করতেন এবং শিয়া হাদিসভান্ডার সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন [১৩]। এর ফলে জিবাল অঞ্চল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের বিস্তৃত অংশগুলো সরাসরি কোমের প্রভাবাধীন হয়ে যায় [১৪, ১৫]।
কোমের হাওযায়ে ইলমিয়া; হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর বরকতময় উত্তরাধিকার
হযরত মাসূমা (সা.আ.)-এর কোমে উপস্থিতির অন্যতম প্রধান ফল হলো এ শহরে হাওযায়ে ইলমিয়ার ভিত্তি স্থাপন। বর্ণনা পাওয়া যায় যে, চতুর্থ হিজরি শতকে এ অঞ্চলে দুই লক্ষাধিক আলেম অবস্থান করতেন [১৬]।
কোমের আলেমদের শিক্ষামূলক প্রচেষ্টায় শত শত গ্রন্থ রচিত হয়, যা ইসলামী দুনিয়ার অন্যান্য শিক্ষা কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়ে শিয়াত্ব প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে [১৭]। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে শাযান কুম্মীর “মাআতু মানকিবা” গ্রন্থ মসজিদুল হারামে পাঠদানে ব্যবহৃত হতো [১৮]।
পরিসমাপ্তি: হযরত ফাতিমা মাসূমা (সা.আ.)-এর হিজরত ও দাফনের ফলে কোম ইরানে শিয়াত্বের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। জিবাল অঞ্চলসহ রেই, কাশান, আভে, ফারাহান প্রভৃতি শহরে শিয়াত্বের বিস্তার ঘটে এবং ক্রমে কেরমানের মতো দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে।
ইমামগণ (আ.)-এর পক্ষ থেকে তাঁর জিয়ারতের ফজিলত সম্পর্কে পুনঃপুন সুপারিশ কোমকে শিয়াদের স্থায়ী গন্তব্যে রূপ দেয়। এই কেন্দ্র থেকে যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে উঠেছে, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বব্যাপী আহলে বাইতের (আ.) শিক্ষার পতাকা বহন করে চলেছে।
নিশ্চিতভাবেই ইরানে শিয়াত্বের স্থায়িত্ব ও শক্তির রহস্য নিহিত আছে হযরত ফাতিমা মাসূমা (সা.আ.)-এর বরকতময় অস্তিত্বে।
পাদটীকা
১. তারিখে কোম, পৃষ্ঠা ৩০৮; খুলাসাতুল বিলাদ, পৃষ্ঠা ১১৭।
২. ফারহাং ও তামাদ্দুনে ইসলামী দার কোম –হিজরি তৃতীয় শতাব্দী, পৃষ্ঠা ১২৮।
৩. হারিমে মোতাহহার বানুয়ে অলীয়ে-কাদরে আহলে বাইত হযরত মাসূমা (সা.আ.), ভূমিকা: উস্তাদ দাওয়ানি, পৃষ্ঠা ৩৪।
৪. তারিখে কোম, পৃষ্ঠা ৩০৯–৩১১; বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৯, পৃষ্ঠা ২৬৫; যাদুল মা’আদ, পৃষ্ঠা ৫৪৭।
৫. শেনাখতনামে কোম ও হযরত মাসূমা (সা.আ.), পৃষ্ঠা ২২৮।
৬. আন-নাকয, পৃষ্ঠা ৫৮৮।
৭. তারিখে কোম, পৃষ্ঠা ৩০৮।
৮. তারিখে কোম, পৃষ্ঠা ৩১৮–৩১৯; কাশান দার মাসিরে তাশায়্যু’, পৃষ্ঠা ১২০–১২৪; তারিখে গোসতরেশে তাশায়্যু’ দার রেই, পৃষ্ঠা ৩২।
৯. তারিখে তাশায়্যু’ দার ইরান আজ আঘাজ তা কারনে না'হমে হিজরি, পৃষ্ঠা ১১৭–১৩২।
১০. মোনাসাবাতে আহলে বাইত ওয়া ইরানিয়ান, পৃষ্ঠা ১৯৫; শেনাখতনামে কোম, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৬৩–৩৬৪।
১১. ইয়াকুত হামাভি, মুজা’মুল বুলদান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৯৯।
১২. পিশগামানে তাশায়্যু’ দার ইরান, পৃষ্ঠা ৫৬।
১৩. তারিখে তাশায়্যু’ দার ইরান আজ অঘাজ তা পায়ানে কারনে না'হমে হিজরি, পৃষ্ঠা ৩০৮।
১৪. তারিখে ইরান দার কুরুনে নোখোস্তিনে ইসলামী, পৃষ্ঠা ৩২৬।
১৫. কোমনামা, পৃষ্ঠা ১৪৩।
১৬. আল্লামা মাজলিসি, লাওআমে সাহেবকরানি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৭৮।
১৭. জাবারি, মাকতাবে হাদিসি কোম, পৃষ্ঠা ১০৮।
১৮. কানযুল ফাওয়ায়েদ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৫; দায়েরাতুল মাআরেফে বুজুর্গে ইসলামী, খণ্ড ৪, বিষয়: “ইবনে শাযান”, পৃষ্ঠা ৫২–৫৩।
আপনার কমেন্ট