বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০২৫ - ১৪:২৪
হোসাইন (আ.)-প্রেমে আবদ্ধ শিশুর প্রতি নবী করীম (সা.)-এর স্নেহময় চুম্মন

যাঁরা আহলে বাইতের (আ.) প্রতি অনুরাগী ও ভক্তিপরায়ণ ছিলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সদা তাদের ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। কেননা আহলে বাইতের (আ.) প্রতি ভালোবাসা কেবল এক আবেগ নয়—এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক সম্পদ, এক স্বর্গীয় রূহানিয়াতের উৎস, যা মানব-হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে, আত্মাকে আলোকিত করে এবং ঈমানকে দৃঢ় ও প্রাণবন্ত করে তোলে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর বিশ্বস্ত সাথীদের শাহাদাত মানবিক স্বাধীনতা, ত্যাগ, সাহস, ধৈর্য এবং আহলে বাইতের (আ.) ওপর নেমে আসা গভীর বেদনার এমন এক বাস্তব প্রতিফলন রচনা করেছিল, যা মানববুদ্ধি ও অনুভূতির সীমা অতিক্রম করে যায়।

মরহুম আয়াতুল্লাহ জিয়া-আবাদী (রহ.) তাঁর এক নৈতিক পাঠে “ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা” শীর্ষক আলোচনায় এক হৃদয়স্পর্শী ও ভাবগম্ভীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের (আ.) প্রতি সীমাহীন ভালোবাসার এক উজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে।

মরহুম শায়খ জাফর শুশতারী (রহ.) এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন— একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে পথ অতিক্রম করছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, কয়েকজন শিশু একসঙ্গে খেলায় মগ্ন। নবী করিম (সা.) তাঁদের মধ্যে এক শিশুর কাছে গিয়ে সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিলেন, নিজের সামনে বসালেন, তার কপালে চুম্বন করলেন এবং স্নেহভরে আদর করলেন।

সাহাবিরা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এই শিশুটির প্রতি এত স্নেহ ও ভালোবাসা কেন প্রদর্শন করছেন?”

নবী করিম (সা.) উত্তর দিলেন— “একদিন আমি দেখেছি, এই শিশু আমার হোসাইনের সঙ্গে খেলছিল। সে হুসাইনের পদধূলি নিয়ে তা নিজের চোখ ও মুখে মেখেছিল। আমি তাকে ভালোবাসি, কারণ সে হোসাইনকে ভালোবাসে। আর জিবরাইল (আ.) আমাকে সংবাদ দিয়েছেন, এই শিশুটি কারবালায় হোসাইনের সঙ্গী ও শহীদদের একজন হবে।”

এরপর নবী করিম (সা.) দোয়া করে বললেন—
”اللهم إني أحب حسيناً، فأحب الله من أحب حسيناً.“
“হে আল্লাহ! আমি হোসাইনকে ভালোবাসি; অতএব, যে হুসাইনকে ভালোবাসে তুমিও তাকে ভালোবাসো।”

শায়খ শুশতারী (রহ.) বলেন—এই দোয়া এক অনন্য সত্য প্রকাশ করে যে আহলে বাইতের (আ.) প্রতি ভালোবাসা কোনো সাধারণ আবেগ নয়; এটি ঈমানের প্রাণ, আত্মার সৌন্দর্য এবং আল্লাহর নৈকট্যের অন্যতম উপায়। আমাদের উচিত এই ভালোবাসাকে জীবনের চেতনা হিসেবে ধারণ করা—যেন তা আমাদের অন্তরকে পবিত্র করে, আমলকে পরিশুদ্ধ করে এবং আমাদের আত্মাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করে।

আশুরার দিনে সংঘটিত ঘটনাবলি মানব ইতিহাসে এক বিস্ময়কর, করুণ ও চিরঅমর অধ্যায়। মানুষ কল্পনাও করতে পারে না, কীভাবে একজন মানব এমন দৃঢ়তা, স্বাধীনতা, সাহস ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর—শায়খ শুশতারী (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী—ইমামের ঘোড়া তাঁর রক্তে ভিজে গেল এবং শোকে উন্মত্ত হয়ে তাঁবুগুলোর (খিমাগুলোর) দিকে ধেয়ে গেল। তিনি বলেন, এই দৃশ্য—
لقد تمرغ فی دم الحسین و قصد نحو الخیمه
—মানব-অনুভূতির সীমা অতিক্রম করে এমন এক গভীর আবেগ ও আধ্যাত্মিক সত্য প্রকাশ করে, যা কেবল প্রেম ও ত্যাগের পরম চূড়ান্ত রূপেই উপলব্ধি করা যায়।

এরপর কিছু লোক নিজেদের মুখমণ্ডল ও শরীর ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র রক্তে রাঙিয়ে, আর্তনাদ ও বিলাপ করতে করতে তাঁবুগুলোর দিকে ছুটে গেল।

এ ঘটনাই প্রকাশ করে যে আশুরার বিকেলে আহলে বাইতের (আ.) ওপর যে গভীর শোক, বিপর্যয় ও বেদনাবিধুরতা নেমে এসেছিল, তা মানব ইতিহাসে আজও এক অনন্য, হৃদয়বিদারক এবং আত্মা-বিদীর্ণকারী স্মারক হিসেবে অমর হয়ে আছে—যা প্রতিটি মুক্তচেতা ও ঈমানদার হৃদয়ে আজও শ্রদ্ধা, অশ্রু ও ভালোবাসার সঞ্চার ঘটায়।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha