বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০২৫ - ১৮:০৭
যে জ্ঞান মানবজাতির মুক্তিতে সহায়ক নয়, তা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতারই রূপ

আয়াতুল্লাহিল উজমা জাফর সুবহানি (দা.বা.) বলেছেন, মানবজাতিকে মুক্তি ও কল্যাণে কাজে লাগানো ছাড়া যে কোনো জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতারই রূপ। তিনি সতর্ক করেছেন, জ্ঞান কখনোই মানুষের ধ্বংস বা যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের উপকরণ হতে পারে না। হাওযা ছাত্র ও সমাজের তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, জ্ঞান অর্জন, ধারাবাহিক অধ্যয়ন এবং আলেমের কলমের মাধ্যমে সমাজকে পথ প্রদর্শন করা মানুষের মহান দায়িত্ব।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ) সন্ধ্যায় আয়াতুল্লাহিল উজমা জাফর সুবহানি (দা.বা.)-এর সাপ্তাহিক নৈতিক পাঠ কোম শহরের ইমাম সাদিক (আ.) ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক আলেম, তালিবে ইলম ও তাঁদের পরিবারবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

মানবতার সেবায় নিবেদিত জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান
বক্তৃতার শুরুতে আয়াতুল্লাহ সুবহানি (দা.বা.) ইমামগণ (আ.)-এর শিক্ষার আলোকে বলেন, “আমরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষসমর্থন করি, তখন সতর্ক থাকতে হবে; এমন জ্ঞানই সমাজে প্রচারিত হওয়া উচিত যা মানবজাতিকে মুক্তি দেয়, জীবনকে সহজ করে এবং মানুষকে মানবতার শিখরে পৌঁছে দেয়। কিন্তু যে জ্ঞান মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়, অস্ত্র নির্মাণে উৎসাহিত করে এবং গণবিধ্বংসী যুদ্ধ সৃষ্টি করে— সে জ্ঞান কোনো মূল্য রাখে না।”

সন্তানদের ব্যক্তিত্ব গঠন: আহলে বাইত (আ.)-এর শিক্ষা
তিনি ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর জীবন থেকে একটি শিক্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেন: একবার ইমাম হাসান (আ.) তাঁর ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সন্তানদের একত্র করে বলেছিলে—
“إنّکُم صِغارُ قَومٍ و یُوشِکُ أن تَکونوا کِبارَ قَومٍ آخَرینَ، فَتَعَلَّمُوا العِلمَ، فَمَن لم یَستَطِعْ مِنکُم أن یَحفَظَهُ فَلْیَکتُبْهُ و لیَضَعْهُ فی بَیتِهِ”

অর্থাৎ: “তোমরা আজ ছোট হলেও শিগগিরই অন্য এক জাতির নেতা হবে। তাই জ্ঞান অর্জন করো, আর যে তা মুখস্থ রাখতে অক্ষম, সে যেন লিখে রাখে এবং তা ঘরে সংরক্ষণ করে।”

এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আয়াতুল্লাহ সুবহানি বলেন— “কোনো ব্যক্তি বা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে চাইলে প্রথমে তাকে মর্যাদা দিতে হবে, তার ব্যক্তিত্বকে বড় করে দেখতে হবে। যেমন একজন পিতা যদি উপদেশ দিতে চান, তবে আগে সন্তানের আত্মমর্যাদা জাগ্রত করতে হবে, তাহলেই সে উপদেশ গ্রহণ করবে।”

ভবিষ্যতের জন্য জ্ঞানে বিনিয়োগ অপরিহার্য
তিনি বলেন— “ইমাম হাসান (আ.)-এর নির্দেশের দ্বিতীয় অংশ ছিল:
‘فَتَعَلَّمُوا الْعِلْمَ وَ حَفِّظُوهُ، وَ إِنْ لَمْ تَسْتَطِیعُوا أَنْ تَحْفَظُوهُ فَاکْتُبُوهُ’
অর্থাৎ—‘জ্ঞান অর্জন করো, মুখস্থ রাখো; যদি মুখস্থ না রাখতে পারো, তবে লিখে রাখো।’

ভবিষ্যৎ প্রজন্মই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। অজ্ঞ ও নিরক্ষর মানুষ কখনো রাষ্ট্র চালাতে পারে না। তাই জ্ঞানই প্রকৃত পুঁজি। তা ফিকহ, দর্শন বা গণিত—যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, শৈশব থেকেই জ্ঞানের বীজ বপন করতে হবে। যদি কারও স্মৃতি দুর্বল হয়, তবে নিয়মিত নোট নিতে হবে ও পুনরায় পড়তে হবে।”

অধ্যবসায় ও ধারাবাহিক শিক্ষার আহ্বান
তিনি আল-তুঘরাই-এর বিখ্যাত কবিতা পাঠ করেন—
“حبُّ السلامةِ يُثْني همَّ صاحبهِ عن المعالي ويُغرِي المرءَ بالكسلِ”
অর্থ: “যে মানুষ শুধু আরাম চায়, সে কখনো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে না; বরং অলসতার জালে আবদ্ধ হয়ে যায়।”

আয়াতুল্লাহ সুবহানি বলেন— “আলেমদের উচিত কঠোর পরিশ্রম করা; ছুটি মানে অধ্যয়ন বন্ধ করা নয়। এমনকি যদি হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর শাহাদাত উপলক্ষে হাওযার ক্লাস বন্ধও থাকে, তবুও ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।”

আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব: নিজে নয়, সমাজকে রক্ষা করা
তিনি হাদিস পাঠ করেন—
“فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِ القَمَرِ عَلَى سَائِرِ النُّجُومِ لَيْلَةَ البَدْرِ”
অর্থ: “আলেমের মর্যাদা ইবাদতগুজার আবেদ ব্যক্তির চেয়ে (পার্থক্য) এমন যেমন পূর্ণিমার চাঁদ অন্য তারাদের চেয়ে উজ্জ্বল।”

ব্যাখ্যায় তিনি বলেন— “একজন ‘আবেদ’ কেবল নিজের পরিত্রাণে মনোযোগী, কিন্তু একজন ‘আলেম’ পুরো সমাজের মুক্তি কামনা করে। নবী-রাসূলরাই সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত, কারণ তাঁরা নিজেদের ত্যাগ করে সমাজকে রক্ষা করেছেন।”

আলেমের কলম শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান
তিনি হাদিস উদ্ধৃত করেন—
“مِدَادُ العُلَمَاءِ أَفْضَلُ مِنْ دِمَاءِ الشُّهَدَاءِ”
অর্থ: “আলেমদের কলমের কালি শহীদদের রক্তের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।”

ব্যাখ্যায় বলেন— “প্রথমে মনে হতে পারে, শহীদের রক্তের উপরে আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ভাবুন, যে শহীদ আত্মত্যাগ করেছে, তাকে এমন আত্মত্যাগী করে গড়ে তুলেছে কোনো আলেমের শিক্ষা ও কলম। যদি শেইখ মুফিদ, শেযইখ তুসি বা অন্য মহাপণ্ডিতেরা না থাকতেন, তবে সেই শহীদরাও গড়ে উঠত না। তাই ‘আলেমের কালি’ মানে এমন জ্ঞান, যা মানুষকে শহীদ হওয়ার প্রেরণা দেয়।”

আয়াতুল্লাহ বোরুজার্দি (রহ.)-এর শেষ জীবনের ঘটনা
আয়াতুল্লাহ সুবহানি স্মৃতিচারণ করেন— “মৃত্যুর অল্প আগে আয়াতুল্লাহিল উজমা বোরুজার্দি (রহ.) বলেছিলেন: ‘ইচ্ছে করে, আমি যদি পর্দা উন্মোচনের (কাশফে হিজাব) বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শহীদ হতে পারতাম; ভয় হয়, হয়তো আখিরাতে খালি হাতে ফিরব।’

তখন আয়াতুল্লাহ গুলপয়গানি (রহ.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘হুজুর, হাদিসে তো বলা হয়েছে— مداد العلماء افضل من دماء الشهداء।’
আয়াতুল্লাহ বোরুজার্দি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, এটি সহিহ হাদিস।’

তখন আয়াতুল্লাহ গুলপয়গানি বললেন, ‘যদি আপনি শহীদ হতেন, তবে আপনার রচিত ও শিক্ষা হতে হাজারো কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত।’
এ কথা শুনে আয়াতুল্লাহ বোরুজার্দি কিছুটা শান্ত হন।

তাঁর রচনা “জামে আহাদিসুশ্ শিয়া” আজও সেই “আলেমের কালি”-র জীবন্ত দৃষ্টান্ত।”

ধ্বংসাত্মক বিজ্ঞান: আধুনিক জাহিলিয়াতের রূপ
আয়াতুল্লাহ সুবহানি সতর্ক করে বলেন— “যে জ্ঞান মানবতার উপকারে আসে, তাকেই সমর্থন করতে হবে। কিন্তু যে জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করে, যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে— তা মূল্যহীন। এটি আধুনিক জাহিলিয়াতের প্রতীক।”

তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর নাহজুল বালাগা-এর একটি অংশ উদ্ধৃত করেন— “জাহিলিয়াতের যুগে মানুষ একে অপরকে ভয় করত; অন্তরে ছিল আতঙ্ক, আর বাহিরে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি।”

তার ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন— “আজও পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই জাহিলিয়াতের ধারাবাহিকতা বহন করছে। রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে ভয় পায়, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
অথচ সত্যিকারের জ্ঞান সেই যা জীবন দেয়, শান্তি আনে, কষ্ট হ্রাস করে; না যে জ্ঞান ধ্বংস, যুদ্ধ ও মানববিনাশ ডেকে আনে।”

আত্মোন্নতির ধারাবাহিকতা
নৈতিক পাঠের শেষে তিনি নবীজির বাণী স্মরণ করিয়ে দেন—
“مَنِ اسْتَوَى يَوْمَاهُ فَهُوَ مَغْبُونٌ، وَمَن كَانَ آخِرُ يَوْمَيْهِ شَرَّهُمَا فَهُوَ مَلْعُونٌ...”
অর্থ: “যার (গতকাল ও আজ) দুই দিন সমান, সে ক্ষতিগ্রস্ত; যার আজকের দিন গতকালের চেয়ে খারাপ, সে অভিশপ্ত।”

তিনি বলেন— “প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা ও আত্মোন্নয়নই জীবনকে অর্থবহ করে। যে ব্যক্তি উন্নতির পথে থেমে যায়, তার জন্য মৃত্যুই উত্তম।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha